পরাধীনতার শেকল ভেঙে প্রিয় জন্মভূমি স্বাধীন হয়েছিল ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বাংলার সূর্য সন্তানরা দেশেমাতৃকার তরে প্রাণ বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।
ময়মনসিংহ শহরের অদূরে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতেও লেগে আছে শহীদের রক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ১১ জন শিক্ষার্থী ও ৬ জন কর্মচারী মিলিয়ে মোট ১৮ জন বীর যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন দেশ মাতৃকার জন্য। তাদের মধ্যে তিন শহীদের নামে বাকৃবিতে রয়েছে তিনটি আবাসিক হল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাকৃবির প্রথম শহীদ মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী মো. জামাল হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৬ এপ্রিল তিনি শহীদ হন। তার নামে বাকৃবিতে 'শহীদ জামাল হোসেন হল' নামে একটি হলের নামকরণ করেছে বাকৃবি প্রশাসন। মো. আক্কাস আলী ও মধুসূদন নামে দুজন কর্মচারী শহীদ হন যথাক্রমে ২২ ও ২৩ এপ্রিল।
২৬ এপ্রিল শহীদ হন কৃষি প্রকৌশলের ষষ্ঠ বর্ষে অধ্যয়নরত নাজির আখতার কাশেম। আব্দুল মতিন খন্দকার (টিপু) শহীদ হন ৮ মে। তিনি মাৎসবিজ্ঞান অনুষদে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। একই মাসের ২৬ তারিখ শহীদ হন ভেটেরিনারি অনুষদের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবুল কাশেম। এরপর জুলাই মাসের ২ ও ৬ তারিখ শহীদ হন যথাক্রমে কৃষি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের খুরশিদ আলম (শিবলী) ও কৃষি প্রকৌশলের ৫ম বর্ষের মো. নাজমুল আহসান। শহীদ নাজমুল আহসানের নামে বাকৃবিতে ছাত্রদের একটি আবাসিক হল রয়েছে। আরেকটি আবাসিক হল রয়েছে শহীদ মো. শামসুল হকের নামে। কৃষি অর্থনীতি অনুষদের চতুর্থ বর্ষে থাকাকালীন তিনি শহীদ হন ১০ আগস্ট। একই দিনে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী মো. নূরুল হক।
শহীদের তালিকা দীর্ঘ হয় নভেম্বর মাসে। এই মাসে শহীদ হন তিনজন। ভেটেরিনারি অনুষদে সদ্য ভর্তি হওয়া কাজী মো. মঞ্জুর হোসেন শহীদ হন ৭ নভেম্বর। গাজী মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও মো. হাসান আলী নামের দুজন কর্মচারী শহীদ হন যথাক্রমে ১৫ নভেম্বর ও ২৯ নভেম্বর। যুদ্ধের একদম শেষের দিকে বিজয় দিবসের ঠিক চারদিন আগে শহীদ হন ভেটেরিনারি অনুষদের প্রথম বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম মোস্তফা কামাল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে একমাত্র শহীদ সহকারী অধ্যাপক এ বি এম আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়া। ১০ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বের হন তিনি। পরবর্তী সময়ে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও রয়েছেন আরও দুইজন শহীদ, যাদের শাহাদাতের তারিখ নিশ্চিত করে জানা যায়নি। তাদের মধ্যে রয়েছেন মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ১ম বর্ষের ছাত্র মনিরুল ইসলাম আকন্দ ও কর্মচারী গিয়াস উদ্দিন।
বিজয় দিবসে শহীদদের স্মরণে বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, শহীদ হয়েছেন আমরা তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ। স্বাধীনতার জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী সবার অবদান অনস্বীকার্য। আমি বাকৃবির ১৮ জনসহ মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও সমবেদনা প্রকাশ করছি।
বাকৃবির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান সরকার বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আমাদের জন্য গৌরবময় এক অধ্যায়। কিন্তু শহীদদের আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল এ দেশের মানুষ ভোগ করতে পারেনি। এজন্য আবারও জুলাই বিপস্নবের মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। এখন আমাদের আরও সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে, যেন এবারের স্বাধীনতা কোনোভাবেই যেন বিফলে না যায়।
দেশকে হানাদার মুক্ত করতে ছাত্র থেকে জনতা, শিক্ষক থেকে কর্মচারী সবাই ছিলেন অগ্রণী। এখন শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার যথাযথ মর্যাদা প্রদান করে সুন্দর দেশ বিনির্মাণ করা বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব।