পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতীতে যেতে বাধ্য হয় ভারত। ভয়ে এই যুদ্ধবিরতী। তাই ভারতীয়দের তোপের মুখে পড়েছেন সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি।
জানা যায়, ভারতীয়দের একাংশের অসহিষ্ণুতা লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে, আরও একবার কি সেটাই প্রমাণিত হলো? এ বার এদের নিশানায় দেশের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি।
পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ–বিরতির আবহে তাঁর বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টি–ন্যাশনাল’, ‘প্রতারক’, ‘বেইমান’ এমন নানা আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
এমনকী তাঁর মেয়েকে টার্গেট করেও অশ্লীল মন্তব্য করা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁর মেয়ে কেন রোহিঙ্গাদের পক্ষে সওয়াল করেন, তা নিয়েও শুরু হয়ে যায় কদর্য চর্চা। যার পরে মিস্রি এক্স–এ নিজের অ্যাকাউন্টটি ব্লক করে দেন। বিদেশ সচিবকে এ ভাবে ট্রোলিংয়ে মূলত একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের চরমপন্থী রাইট উইং সাপোর্টাররাই জড়িত বলে অভিযোগ।
এর পাল্টা মিস্রির পক্ষেও অবশ্য দাঁড়ান অনেকে। এঁদের মধ্যে আছেন কংগ্রেসের সলমন খুরশিদ, শশী থারুর, মিম–এর আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, সাংবাদিক বীর সাংভি, মহম্মদ জ়ুবেইর থেকে অবসরপ্রাপ্ত আমলারা।
কেন এই ট্রোলিং? গত মাসে পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার সপ্তাহ দুয়েক বাদে পাকিস্তানে প্রত্যাঘাত চালায় ভারত। ‘টার্গেটেড’ হামলায় পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদীদের একাধিক ডেরা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বলে দাবি করে দিল্লি। পাল্টা দেয় ইসলামাবাদ। এই সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের তরফে যাবতীয় বক্তব্য সামনে আনেন বিদেশ সচিব মিস্রি, যিনি নিজে শ্রীনগরেরই মানুষ। এই কাজে তাঁর সঙ্গে থেকেছেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কম্যান্ডার ব্যোমিকা সিং।
‘অপারেশন সিঁদুর’–এ ভারত কী ভাবে পাকিস্তানকে দুরমুশ করেছে, বিস্তারিত ভাবে সে কথাই দেশবাসীকে জানান তাঁরা। সে ভাবেই শনিবার সন্ধেয় ‘সিজ়ফায়ার’ বা সংঘর্ষ–বিরতির কথাও মিস্রি ঘোষণা করেন। এর নেপথ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতা ছিল কি না, সেটা অবশ্য বিদেশ সচিব স্পষ্ট করেননি। তবে তাঁর ঘোষণার ঘণ্টাকয়েক বাদেই পাকিস্তান হামলা চালাতে থাকে ভারতের নানা জায়গায়। যা নিয়ে সরব হয় একাধিক বিরোধী দল। পাশাপাশি বাড়ে ট্রোলিংয়ের মাত্রা।
সংঘর্ষ–বিরতির ঘোষণার পরে নেটিজ়েনদের একাংশ মিস্রিকে যে ভাবে নিশানা করে, তাতে মনে হয় যেন এটা তাঁরই সিদ্ধান্ত। লেখা হয়, তিনি নাকি ‘দেশকে বিক্রি’ করে দিয়েছেন! অথচ ওই সিদ্ধান্ত হয় একেবারে শীর্ষ স্তরে। যেখানে মিস্রির ভূমিকা খুব সীমিত। তা সত্ত্বেও তাঁকে এবং তাঁর মেয়েকে (যিনি বাবার অফিশিয়াল কাজকর্মে মোটেই জড়িত নন) টার্গেট করা হয়।
তবে এই পর্বে ট্রোলিংয়ের ঘটনা আগেই সামনে এসেছে। পহেলগামে ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক পরিবার জানিয়েছিল, যে সন্ত্রাসবাদীরা হানাদারি চালায়, তাদের কোনও ধর্ম নেই। বরং কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ আন্তরিক ভাবে পাশে দাঁড়ানোয় তাঁদের প্রশংসা করে পরিবারগুলি। এই নিয়ে শুরু হয় ট্রোলিং। যে বায়ুসেনা জওয়ান ওই হামলায় প্রাণ হারান, তাঁর স্ত্রী হিমাংশী নারওয়ালও এই ঘটনায় সাম্প্রদায়িক রং চড়ানোর বিরোধিতা করে ট্রোলিংয়ের শিকার হন। যদিও কোনও ক্ষেত্রেই সরকারের তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শনিবার মিস্রি শুধু জানিয়েছিলেন যে, গোলাগুলি, মিলিটারি অ্যাকশন সাময়িক ভাবে বন্ধের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে দু’দেশ। যার পরে তাঁর আচরণকে ‘লজ্জাজনক’ বলা হয়। জয়শঙ্কর, দোভালদেরও এ প্রসঙ্গে টেনে এনে বলা হয়, এঁরা সবাই ‘বিক্রি হয়ে গিয়েছেন’।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মওকায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খানিকটা তেতো করা যেত এবং তাতে বিভাজনের পথ প্রশস্ত হতে পারত বলে মনে করেছিল অনেক দক্ষিণপন্থী। সে গুড়ে হঠাৎ বালি পড়ে যাওয়াতেই মিস্রিকে বিশ্রী ভাবে নিশানা করা হয়েছে। এ ভাবে মোদী সরকার আদতে বিদেশ সচিবকে ‘বলির পাঁঠা’ বানাল বলেও অনেকের মত।
এর বিরুদ্ধে মুখ খুলে ওয়াইসি বলেন, ‘দেশের স্বার্থে কঠোর পরিশ্রম করা এক মার্জিত কূটনীতিক বিক্রম মিস্রি। আমাদের আমলারা সিদ্ধান্ত দেন না, তা পালন করেন শুধু। সিদ্ধান্ত নেন ক্ষমতায় থাকা নেতৃত্ব।’ কংগ্রেস কেরালার অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডলেও কড়া সমালোচনা করা হয়।
কে এই আমলা?
তিন দশকেরও বেশি সময়ের কেরিয়ার এই আমলার। আইকে গুজরাল, প্রণব মুখোপাধ্যায়রা যখন বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, তখন পাকিস্তান বিষয়ক কাজেই যুক্ত ছিলেন মিস্রি। এ বাদে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং গুজরাল, মনমোহন সিং ও নরেন্দ্র মোদীর প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন। ২০২৪–এর ১৫ জুলাই তিনি বিদেশ সচিব হন। এবং পহেলগামের ঘটনার পরে ভারতকে বিশ্বের সামনে সফল ভাবেই তুলে ধরেছেন তিনি।