শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন

আর কে চৌধুরী
  ২৬ মার্চ ২০২১, ০০:০০
স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন
স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন

২৬ মার্চ- বাঙালির মহান স্বাধীনতা দিবস। এদিন বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাদের নয় মাস লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলাম। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পুনর্গঠনের কাজেও শরিক হতে পেরেছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ছিলাম। তখন বিভিন্ন প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর বাসায় যেতাম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে বললাম, লিডার একটু ক্যান্টনমেন্ট যাব। এখানে বলে রাখি ক্যান্টমেন্টের সঙ্গে আমার ফার্নিচারের ব্যবসা ছিল। ইস্টার্ন ফার্নিচার নামে আমার একটি ফার্নিচারের প্রতিষ্ঠান ছিল। আমি ক্যান্টনমেন্ট গিয়েছিলাম ফার্নিচারের বিল আনতে। আমরা ওই দিন ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি একটু অন্যরকম মনে হলো। ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে সংবাদটি পৌঁছেছিলাম। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে ২৬ মার্চের শুরুতেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন দেশের স্বাধীনতা।

1

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী টালবাহানা শুরু করে। সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১ মার্চ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চের দিকনির্দেশনামূলক সেই ভাষণের পথ ধরেই ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল অস্থায়ী সরকার। এ সরকারের নেতৃত্বেই দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অভু্যদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতীয় জীবনেই শুধু নয়, মুক্তিকামী সারা বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত মানুষের কাছে এক অনন্য সাধারণ ভাষণ হয়ে আছে।

স্বাধীনতা যে কোনো জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও তা এক মহাসত্যি। এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করেছে রক্তস্নাত পথ ধরে। স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে জয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারা রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম গণহত্যা। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে ২৬ মার্চের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ডাক দেন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর এর মাধ্যমেই অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহিমান্বিত বিজয়।

মহান স্বাধীনতার দিনে আমরা স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা নিগৃহীত দুই লাখ মা-বোনকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু-সুহৃদ, বিশাল হৃদয় বিদেশি বন্ধুদের। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীকে যার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে সমগ্র বিশ্বের জনমত পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন করেছিল। দলমত নির্বিশেষে ভারতের প্রতিটি জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন ও সহায়তা করায় আমরা তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ।

আমি একজন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলছি, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়টি মাস। এই নয় মাসকে কেন্দ্র করেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম আনন্দ-বেদনার স্মৃতি। আমি প্রত্যক্ষ করেছি একটি স্বাধীন দেশের অভু্যদয়, দেখেছি সহযোদ্ধার লাশ আর আপন সন্তানের নিথর দেহ।

যৌবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ঢাকা শহরের গণআন্দোলনের অনেক কর্মকান্ডেই ছিল আমার সক্রিয় অংশগ্রহণ। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল। ২৫ মার্চ ক্র্যাক ডাউনের পর ২৭ মার্চ হেঁটে, রিকশা এবং নৌকায় অনেক কষ্টে নরসিংদী পৌঁছলাম। চলতে লাগল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। যোগাযোগ হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত মেজর নূরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি ক্যাপ্টেন মতিউরকে পাঠালেন যুদ্ধ প্রস্তুতির সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে গিয়ে ক্যাপ্টেন মতিউর আবার নরসিংদী এলেন ৩০ মার্চ, সঙ্গে বহু ইপিআর সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রসহ। নরসিংদীর জনগণ উজ্জীবিত হয়ে ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। ২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মতিউরের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েকটি গ্রম্নপে বিভক্ত হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বিকালে নরসিংদীর পাঁচদোনা পৌঁছলে পাকবাহিনী নৌ, রেল ও স্থল তিনদিক থেকে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। শত্রম্ন বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। তাদের অতর্কিত আক্রমণে আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও অসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ চালাতে থাকলাম। পাকবাহিনীর ৮-১০ জন সৈন্য হতাহত হলো। উড়িয়ে দেওয়া হলো তাদের দুটি গাড়ি। আমাদের কয়েকজন হতাহত হলো। সেই স্মৃতি এখনো আমাকে নাড়া দেয়।

নরসিংদীর স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রস্তুতি নিলাম ভারত যাওয়ার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিলস্না, নোয়াখালী ও সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকামীদের প্রথম এবং সহজতম আশ্রয়স্থল ছিল ত্রিপুরার আগরতলা। আগরতলা পৌঁছালাম। পেলাম পরিচিত মুখ মেজর নূরুজ্জামানসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী ও ঢাকার অনেক সংগঠকদের। আগরতলা মুখরিত হলো মুক্তিকামী বাঙালিদের পদভারে। বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা- যে মামলাকে কেন্দ্র করেই ফাঁসিতে ঝোলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল জাতির পিতাকে। বিস্ময়করভাবে সেই আগরতলাই হয়ে উঠল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ডেডলাইন।

ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থান অদ্ভুতভাবে গাঁথা বাংলাদেশের সঙ্গে। ভারতের অন্যান্য অংশ যেখানে একদিক থেকে বেঁধে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ তিনদিক থেকে আলিঙ্গন করে আছে ত্রিপুরাকে। ত্রিপুরার ৯১৭ কিলোমিটার সীমান্তের ৮৩৯ কিলোমিটারই বাংলাদেশের সঙ্গে। রাজধানী আগরতলা- যেখানে আর্যদের পা পড়েনি, আসেনি কোনো বিদেশি। সারা বাংলায় যখন বাংলা ভাষার সরকারি মর্যাদা ছিল না, ইংরেজি ও ফার্সি যখন সব কিছুর উপর দাঁড়িয়ে ত্রিপুরার রাজভাষা তখনো বাংলা। পাহাড়ি ত্রিপুরার যে হূদ্যতা, সেই হূদ্যতা ক্রমেই বাড়া বৈ কমেনি। মহারাজাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা যেমন ইতিহাস তেমনি ১৯৭১-এর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে পরবর্তী প্রজন্মের ত্রিপুরাবাসীর তেমন ইতিহাস। ১৯৭১ সালে সমগ্র ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ১৫.৫৩ লাখ অথচ ত্রিপুরা ধারণ করেছিল ১৩.৪২ লাখ বাংলাদেশ ত্যাগী শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা।

'৭১-এর এপ্রিল মাসে আমি আগরতলা যাই। মূলত সেখানেই সর্বজনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, শেখ জামাল, আবদুস সামাদ আজাদ, গাজী গোলাম মোস্তফা, কর্নেল ওসমানী, মেজর জিয়া, মেজর শফিউলস্নাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার, মেজর নূরুজ্জামান প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে যুদ্ধ বিষয়ে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টার। সে দায়িত্ব থেকেই ২৫ এপ্রিল আমি খালেদ মোশাররফ ও কুমিলস্নার হোমনার এমপি মোজাফফর আলী প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করি। তার নির্দেশনা গ্রহণ করে কলকাতা থেকে আগরতলায় ফিরে আসি। সংগঠক হিসেবে সে সময়ে মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পসহ ত্রিপুরার অনেক ক্যাম্পেই প্রতিনিয়তই যেতে হতো আমাকে। সূর্যমনিনগর হাসপাতাল যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। পরিদর্শনে গিয়ে দেখা হলো আমার স্কুলজীবনের বন্ধু ডা. জাফরউলস্নাহ চৌধুরীর সঙ্গে সে বর্তমানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি। এ সময়ে অর্থাৎ ২৮ মে তৎকালীন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে কথা বলারও সুযোগ হয় আমার।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে এমপি, মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিলে আমি ১ জুন হোমনার এমপি মোজাফফর আলী ও ছাত্রলীগ নেতা আলীসহ হবিগঞ্জের মাধবপুর বর্ডার দিয়ে দেশে প্রবেশ করি। রাত ২টা ৩০ মিনিটে বর্ডার ক্রস করতে সাহায্য করলেন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন। সকালে চারগাছ বাজারে চা-নাশতা করার সময় লক্ষ্য করলাম স্থানীয় লোকজন আমাদের সন্দেহের চোখে দেখছে। সে সময়ে দেশে শত্রম্ন-মিত্র চেনা খুবই দুরূহ ছিল। সে কারণে দেরি না করে হোমনার উদ্দেশে রওনা হলাম। সারাদিন চলার পর রাতে ঝড়-বাদলে মাঝি পথ হারিয়ে ফেলাতে অনেক কষ্টে ৩ জুন সকালে মোজাফফর আলী এমপির এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাম। পরদিন সকালে বাঞ্ছারামপুরের এমপি মহিউদ্দিনের খোঁজে তার এলাকায় গিয়ে তাকে পেলাম ডোমরাকান্দিতে। এরপর রায়পুরার এমপি আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়ার সঙ্গে দেখা হলো নিলক্ষিয়ায়। শিবপুর-মনোহরদীর এমপি ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হাইরমারা গ্রামে। তাদের সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর মেসেজ জানাই এবং তারা সবাই আগরতলায় তথা ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হন। এভাবে ২১ জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে এমপি, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিকামী বাঙালিদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে আলোচনা ও সাক্ষাৎকার কার্যক্রম চালাই। ২২ জুন নিজ গ্রাম নরসিংদীর আলোকবালীতে যাই। অপেক্ষা করছিল দুঃসংবাদ। জানতে পারলাম আমার সন্তান বিপস্নবের বিনা চিকিৎসায় মৃতু্যর সংবাদ। চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ। আমাদের বাড়িতে ২৯ জুন রাতে পরিবার-পরিজনসহ এলেন নরসিংদীর এমপি মোসলেহউদ্দিন। তাকে পেয়ে আমার কাজে অনেকটাই সুবিধা হলো। এ সময়ে আলোকবালী নিরাপদ নয় ভেবে পরিবার-পরিজন স্থানান্তর করলাম বাঞ্ছারামপুরে। সেখানেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলো আমার ছোট মেয়ে সুইটি। পরে সেও হোমনাতে মারা গেল এক প্রকার বিনা চিকিৎসাতেই। পরিবার-পরিজন রেখে ৩০ জুলাই আবারও ঢাকার পথে রওনা হলাম। হেঁটে, নৌকায়, রেলপথে ও রিকশায় অনেক কষ্টে ঢাকায় পৌঁছালাম ৩ আগস্ট রাতে। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মান্ডা, মুরাদপুর ও আশপাশের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ১৭ আগস্ট নরসিংদী রওনা হয়ে ১৯ আগস্ট পৌঁছালাম। নরসিংদী তখন ভীষণ উত্তপ্ত। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দৌরাত্ম্য তখন চরমে। এর মধ্যেই বাড়াইল হয়ে আমার গ্রাম আলোকবালীতে পৌঁছালাম। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশনা দিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে আবারও রওনা হলাম আগরতলার উদ্দেশে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে দুই-এক জায়গায় ছদ্মবেশে অনেক বিপদ এড়িয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করলাম। ২৫ সেপ্টেম্বর মেজর নূরুজ্জামান ও ২৬ সেপ্টেম্বর গাজী গোলাম মোস্তফাকে দেশের অভ্যন্তরের যুদ্ধ পরিস্থিতি বর্ণনা করলাম এরপর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আগরতলা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন এবং অন্যান্য সাংগঠনিক কাজে ভারতেই ছিলাম- দেশে আর আসা সম্ভব হয়নি। দেশে এলাম ১৪ ডিসেম্বর মেজর হায়দারসহ হেলিকপ্টারে কুমিলস্নায়। পরে নরসিংদী হয়ে ঢাকায় এলাম ১৫ ডিসেম্বর বিকালে। যাত্রাবাড়ীতে সেদিনই বিজয় উলস্নাস। সে স্মৃতি সারাজীবন মনে রাখার মতো- জনতা মেজর হায়দার ও আমাকে মাথায় নিয়ে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় নাচতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর কাটল আনন্দ আর উৎকণ্ঠায়। অবশেষে এলো জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকা ক্লাব থেকে আনা হলো চেয়ার-টেবিল- যে টেবিলে স্বাক্ষরিত হলো বাঙালির বিজয়ের দলিল। ১৬ ডিসেম্বরের সেই দৃশ্য সুখ-স্বপ্ন হয়ে আছে এখনো।

এখানে উলেস্নখ্য, আমরা তিন ভাই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। বাকি দুজনের নাম শাহ আলম চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আমার ভগ্নিপতি এ কে এম বজলুর রহমান ১৯৬৯ সালে গণঅভু্যত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০-এর পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্মুখ সমরে। তিনিই সর্ব প্রথম আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য 'স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২১'-এর জন্য মনোনীত (মরণোত্তর) হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ভাষাসৈনিক এ কে এম বজলুর রহমান।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে