শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা

বাংলাদেশ ও বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকার অধিক গুরুত্বের দাবিদার। অন্যভাবে বলা যায়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিকনির্দেশনা ছাড়া এত অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর ছিল না।
অধ্যাপক রাকিবা ইয়াসমিন
  ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং স্বাধীনতা অর্জনে প্রবাসী সরকারের ভূমিকা বাঙালি জাতির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় ও অনন্য অসাধারণ ঘটনা। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি তখন বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক নির্দেশনামূলক ভাষণের আলোকে সব কর্মকান্ড পরিচালনা করেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও দমননীতির বিরুদ্ধে। তার নির্দেশনা অনুসারে ১০ এপ্রিল ভারতের (আগরতলায়) মক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। এ সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেন এবং 'মুজিবনগর সরকার' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শপথ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয় এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে চিরতরে নির্মূল করার অঙ্গীকার করা হয়। অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তার অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। প্রবাসে অবস্থান করে এ সরকার মুক্তিযুদ্ধে দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকে। যুদ্ধের সশস্ত্রবাহিনীর নামকরণ করা হয় মুক্তিবাহিনী এবং এর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। শপথ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার অল্পক্ষণ পরেই পাকি সৈন্যরা বৈদ্যনাথ তলার আম্রকানন দখল করে নেয়। এ জন্য সরকারের মন্ত্রিবর্গকে ভারতের কলকাতায় অবস্থান করে দাপ্তরিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে হয়। তাই এটির নামকরণ করা হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। কলকাতায় অবস্থান করলেও এ সরকার সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। যুদ্ধকালে বিবেচনায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। কারণ মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের নীতি-নির্ধারণমূলক সিদ্ধান্তগুলো সংসদে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধ করে আন্দোলন ও জনমত গঠন করা। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে প্রবাসী সরকারের পক্ষে প্রচারণার জন্য ঊীঃবৎহধষ চঁনষরপরঃু জোরদার করা হয়। সুতরাং বলা যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বহির্বিশ্বের সহযোগিতা ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভের বিষয়টি বৃহত্তর পরিসরে তদারকি করত। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে প্রবাসী সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সোবহান যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন তিনি পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতির চিত্র তুলে ধরেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৭ এপ্রিলের ভাষণের লিখিত কপি প্রচারের ব্যবস্থা করেন। রেহমান সোবহান ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্ক বাঙালি কূটনীতিকদের নিয়ে একটি বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের চেষ্টা করেন। প্রবাসী সরকারের প্রচেষ্টায় ৪ আগস্ট ৬ জন কূটনীতিকসহ ১৪ জন বাঙালি পাকিস্তানের পদত্যাগ করে বাংলাদেশের আনুগত্যতা প্রকাশ করে। প্রবাসী সরকারের কূটনৈতিক সফলতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজনগণ, সংস্থা, সংগঠন ও প্রখ্যাত ব্যক্তিরা বাংলাদেশে মানবিকতা ও স্বাধীনতার পক্ষে সবলম্বন করে। কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে বিদেশি কূটনীতিকরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে এসেছেন এবং তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে সে দেশের জনগণ ও সরকারের সমর্থন লাভ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের স্বাক্ষর বহন করে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক মিশন বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা ও জনমত গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিচিতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার জন্য সেনাবাহিনী বা মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের মূল কাজ। উদ্বাস্ত শিবিরের তত্ত্বাবধানের জন্য ভারত সরকার চিকিৎসক নিয়োগ করেছিল। বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনুদান হিসেবে ওষুধ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ এবং সেগুলোকে বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানোর দায়িত্বও স্বাস্থ্যবিভাগের কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সেক্টরের জন্য সরঞ্জামাদি অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি সংগ্রহের দায়িত্ব এ বিভাগের উপর অর্পণ করা হয়েছিল। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক আয় ও ব্যয়ের হিসাব পরিচালনার দায়িত্ব ছিল সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের। বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আহরিত অর্থ ভারতীয় অর্থের সঙ্গে বিনিময় সাপেক্ষে তা ব্যয় করা হতো। ভারত সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবাসী সরকারকে ১০ কোটি রুপি প্রদান করে যা প্রবাসী সরকারের অর্থনীতির ভীত রচনা করে। এ সরকারের (প্রবাসী সরকার) স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল। স্থানীয় প্রশাসন বিন্যস্ত ও শক্তিশালীকরণ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, শরণার্থীদের ভরণ-পোষণ ও আবাসনের ব্যবস্থা করা। এ সব ক্ষেত্রগুলো আলোচনাপূর্বক স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার কোনো বিচ্ছিন্ন সরকার নয়, বরং এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এ সরকারের প্রকৃতি ও কাঠামোগত ভিন্নতা থাকলেও সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় প্রবাসী সরকারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।

1

প্রবাসী বাংলাদেশে সরকার প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যাপৃত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং যুদ্ধকালীন প্রতিনিয়ত যোগদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের একক নেতৃত্বের অধীন একটি 'ঈযধরহ ড়ভ ঈড়সসধহফ' নিয়ে আসার জন্য একজন প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করেন। প্রধান সেনাপতির অধীনে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতি সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধকে সরকারে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। এ ব্যাপারে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার প্রথমে বিএসএসের মাধ্যমে এবং পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য যুদ্ধসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করে। সুতরাং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, ভারতের জনগণ ও ভারতীয় সৈন্যের অবদান অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে উলেস্নখ্য, প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নামমাত্র জনবল দিয়ে। তবে তাদের দেশপ্রেম এবং আন্তরিকতার কোনো তুলনা হয় না এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্য। কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যে তার কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা ও প্রাধান্য মাঠপর্যায়ের প্রশাসনেও পরিলক্ষিত হয় এবং এটি প্রবাসী সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

১৯৭১ সালে ২১ নভেম্বর ভারতের সীমান্ত বয়রা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকিবাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পরে বাংলাদেশ এবং ভারতের সেনা অফিসারদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথবাহিনী গঠিত হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নতুন গতি ও শক্তি সঞ্চারিত হয়। ৮ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ শুরু হলে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকা এবং কয়েকটি সেনানিবাস ছাড়া অধিকাংশ অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয় এবং যৌথবাহিনীর দখলে চলে আসে। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে প্রথমে জে. নিয়াজী এবং পরে জে. অরোরা আত্মসমর্পণে দলিলে স্বাক্ষর প্রদান করলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় আগমন করেননি। প্রবাসী সরকারের সাধারণ প্রশাসন বিভাগের সচিব নুরুল কাদের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার সচিবালয় যান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম শুরু করেন। ২২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা ঢাকায় আসেন এবং নিজ নিজ কার্যভার গ্রহণ করেন। ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে দিলিস্নতে কয়েক ঘণ্টার জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের জনগণের উদ্দেশ্যে শ্রীমতি গান্ধী বলেছিলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগণকে প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার এবং তিনি তা দিয়েছেন। আমি প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশের শরণার্থীদের সসম্মানে দেশে ফেরত পাঠাব, মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সাহায্য করব এবং বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনব। আমিও আমার প্রতিশ্রম্নতি রক্ষা করেছি'।

১২ জানুয়ারি প্রাবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শুভযাত্রা শুরু হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন হিসেবে ১৯৭২ সালে সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তনপূর্বক দেশগড়ার স্বপ্নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। সুতরাং বাংলাদেশ ও বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকার অধিক গুরুত্বের দাবিদার। অন্যভাবে বলা যায়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিকনির্দেশনা ছাড়া এত অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর ছিল না।

অধ্যাপক ড. রাকিবা ইয়াসমিন : লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইবি। ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে