বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
পাঠক মত

জলবায়ু পরিবর্তনে জনজীবন ও জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব

  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
জলবায়ু পরিবর্তনে জনজীবন ও জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনে জনজীবন ও জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব

সময়ের ধারাবাহিকতায় বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। প্রকৃতির গতিপ্রকৃতি পাল্টে যাওয়ায় জনজীবনে এসেছে পরিবর্তন। প্রতিনিয়ত মানুষকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শুধু জীবনধারণের প্রয়োজনে। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকতে হচ্ছে। জনজীবন এখন আর প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে পারছে না।

বরং প্রকৃতি তাদের বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বছরের পর বছর মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বৈরী প্রভাবের ফলে জীববৈচিত্র্য ও ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। এ সব পরিবর্তনের জন্য বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে দায়ী করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির চেহারা বদলে যাচ্ছে বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের। প্রতিনিয়ত সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। টিকে থাকতে হচ্ছে সংগ্রাম করে। উপকূলের মানুষের। উপকূলের দীর্ঘ এলাকায় প্রতি বছর দুর্যোগে হাজারো মানুষের প্রাণ যায়। কোটি কোটি টাকার সম্পদ হানি ঘটে। সময়ের ধারাবাহিকতায় পরিবেশ উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া পরিবারগুলো ভাসমান দিন কাটায়। তারা অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করে। সময়ের বিবর্তনে উপকূল অঞ্চলের জীবনধারায় এসেছে নানা পরিবর্তন। প্রতিটা মানুষের পেশা বদলে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে যারা মাছ বিক্রি করত তারা অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। কেউ কেউ শহরের দিকে পা বাড়ায়। কৃষকরা আর চাষাবাদের দিকে এগোয় না। চাষাবাদের মাধ্যমে দিনাতিপাত করা কষ্টকর হয়ে ওঠে। তারা পৈতৃকভূমি হারিয়ে ফেলছে। ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। বিশুদ্ধ খাবার পানিরও সংকট দেখা যায়। এরই মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার ভয়াবহতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে উপকূলবাসীদের জীবন-জীবিকার ধরন। প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের ওপর। প্রকৃতির রুদ্ররূপে সুন্দরবন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অকাল বৃষ্টি, খরা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে সব ধরনের পেশায়। মৌসুম কখনো এগিয়ে আসছে কখনো বা পিছিয়ে যাচ্ছে। দেশের উপকূলের ১৯ জেলায় প্রায় ৪ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। যা দেশের আয়তনের শতকরা ৩২ ভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ এ সব এলাকায় প্রকৃতির মতিগতি দ্রম্নতই বদলে যাচ্ছে। মানুষের বেঁচে থাকার সুযোগগুলো হ্রাস পাচ্ছে। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল গরিব মানুষের দুঃখ ও দারিদ্র্য দুই-ই বাড়ছে। এ সব কিছুই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য। যা সাধারণ মানুষ এখনো টের পাচ্ছে না। ১৯৯১ থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ৯৩টি বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে মৃতু্য ঘটেছে প্রায় ২০০০,০০০ জনের এবং কৃষি ও অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ও প্রায় ৫.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪১৩০০ কোটি টাকা)। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে গৃহহারা হবে প্রায় ৩ কোটিরও বেশি মানুষ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর গতিপথ পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৩৫ মিলিয়ন বা সাড়ে তিন কোটি মানুষ গৃহহারা হয়ে যাবে।

1

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষক প্রফেসর নরম্যান মাইরিস তার গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ৪০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি মানুষ বাস্তুচু্যতির শিকার হবে। আর সবচেয়ে বেশি বাস্তুচু্যতি ঘটবে বাংলাদেশেই। প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা অধিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হলো গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রতিক্রিয়া। সাধারণত সূর্য থেকে যে তাপশক্তি পৃথিবী পৃষ্ঠে আসে তার কিছু অংশ পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে এবং অধিকাংশ বিকরিত হয়ে আবার বায়ুমন্ডলে চলে যায়। কিন্তু বায়ুমন্ডলে ব্যাপক পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস জমা হওয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপ বিকিরণ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এ সব গ্যাস তাপ শোষণ করে।

ফলে দেখা যায় ক্রমাগত ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ উত্তপ্ত হচ্ছে। গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো যেমন- কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড এবং সালফারের অন্যান্য অক্সাইডগুলো, নাইট্রিক অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুওরো কার্বন ইত্যাদি। গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো পৃথিবীর স্থান থেকে তাপ বিকিরণ করে। এই তাপ, ইনফ্রারেড বিকিরণ রূপে, গ্রহের বায়ুমন্ডলে এই গ্যাসগুলো দ্বারা শোষিত এবং নির্গত হয় ফলে নিম্ন বায়ুমন্ডল এবং পৃষ্ঠকে উষ্ণ করে। পৃথিবীতে, স্বাভাবিকভাবেই গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণযুক্ত বায়ুমন্ডলে পৃষ্ঠের কাছে বায়ু তাপমাত্রা প্রায় ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৫৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কম থাকে, যা তাদের অনুপস্থিতিতে কমাবে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ছাড়া, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা জলের তাপমাত্রার চেয়ে কম হবে। প্রধান গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো ওয়াটার বাষ্প, যা গ্রিনহাউস প্রভাবের প্রায় ৩৬-৭০% কারণ সৃষ্টি করে; কার্বন ডাইঅক্সাইড (ঈঙ২), যা ৯-২৬% কারণ; মিথেন (ঈঐ৪), যা ৪-৯% কারণ; এবং ওজোন (ঙ৩), যা ৩-৭% কারণ। সূর্য পৃথিবীর প্রাথমিক শক্তি উৎস হিসাবে, আগত সূর্যালোকের পরিবর্তন সরাসরি জলবায়ু ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। সৌর অনাক্রম্যতা ১৯৭৮ সাল থেকে সরাসরি উপগ্রহ দ্বারা পরিমাপ করা হয়েছে, কিন্তু পরোক্ষ পরিমাপ ১৬০০-এর দশকের শুরুর দিকে শুরু হতে পারে। সূর্যের শক্তি পৃথিবীতে পৌঁছানোর পরিমাণে কোনো ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নেই, তাই এটি বর্তমান উষ্ণায়নের জন্য দায়ী নয়। শারীরিক জলবায়ু মডেলগুলো সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সৌর আউটপুট এবং আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপে কেবল বৈচিত্র্য বিবেচনা করে দ্রম্নত উষ্ণায়নের পুনরুৎপাদন করতে পারে না। গবেষকরা ও পরিবেশবিদরা বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে নিম্নোক্ত চারটি পদক্ষেপকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করছেন: ১. মানব সচেতনতা। ২. গাড়ির ধোঁয়া, কারখানার ধোঁয়া ইত্যাদি রোধ। ৩. সিএফসি নির্গত হয় এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমিয়ে আনা। ৪. জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশে জলবায়ুর প্রভাব বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলছে। অসময়ে বৃষ্টি, ঝড়, তুফান, আইলা ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি দুর্যোগ হানা দিচ্ছে প্রতিবছরই। এসব থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে যদি নিজেরা সচেতন হই। পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে। সবশেষ কথা নতুন নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের প্রতিবছর আঘাত করছে। তারপর যখন সবকিছু কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায় তখন আবারও কোনো নতুন দুর্যোগের কবলে পড়ে। তার থেকে ভালো পৃথিবীতে এক লাখ কোটি গাছ লাগিয়ে পরিবেশটা সেই নির্মল করে তোলা। এর ফলে বাতাসও বিষমুক্ত হবে আবার উষ্ণায়নের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। সেই কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে সর্বস্তরের জনগণকে, এতে কিছুটা হলেও দুর্যোগ হ্রাস পাবে।

রামিছা বিলকিছ জেরিন

শিক্ষার্থী

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে