শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

ফ্রিল্যান্সিং ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

গুণগত মান বজায় রাখতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফ্রিল্যান্সিং বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
মো. টুটুল মোল্যা
  ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
ফ্রিল্যান্সিং ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

একটি ল্যাপটপ/ডেস্কটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ, সঙ্গে সামান্য প্রশিক্ষণকে সম্বল করে বাংলাদেশে বর্তমানে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের অন্যতম পস্ন্যাটফর্ম হলো আউটসোর্সিং তথা ফ্রিল্যান্সিং। ফ্রিল্যান্সিং হলো অনলাইনে বিভিন্ন সোর্স থেকে কাজ করে আয় করার আধুনিক অফিস। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার ফ্রিল্যান্সার বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে ৫০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা) আয় করেন- যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং বাংলাদেশের বেকার সমস্যার সমাধানে সুদূরপ্রসারী অবদান রাখছে। অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট (ওআইআই) সম্প্রতি একটি গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং সেবা প্রদানকারী দেশ- যা ১৬% ফ্রিল্যান্সিং সেবা প্রদান করছে, যেখানে ভারত ২০% ফ্রিল্যান্সিং সেবা দিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশি তরুণদের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে গেস্নাবাল ফ্রিল্যান্সিং হাব এ পরিণত হবে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং।

আমাদের দেশে প্রায় ১৬০০ রকমের ফ্রিল্যান্সিং সেবা দেওয়া হয়। ফ্রিল্যান্সিং এ সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজ হলো কম্পিউটার প্রোগ্রামিং অ্যান্ড টেক, গ্রাফিক্স ডিজাইন, রাইটিং অ্যান্ড ট্রান্সেলেশন, ভিডিও অ্যান্ড এনিম্যাশন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ডিজাইন, ট্র্যাক্স ফাইল প্রস্তুতি, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন ইত্যাদি। বাংলাদেশি তরুণদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং-এ আরো আধুনিকতম করে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রোসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)-এর গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং ? ২৪% গ্রোথে পৌঁছাতে পেরেছে। বাংলাদেশ সর্বপ্রথম ২০০৮ সালে ফ্রিল্যান্সিং যুগে প্রবেশ করে। তখন মাত্র ৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার অর্জন করতে সক্ষম হয়- যা এখন বেড়ে ৫০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। অকল্পনীয় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে একমাত্র বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের জন্য শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ইন্টারনেট সরবরাহ সুবিধাকরণের মাধ্যমে। যার ফলে, বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং সেবার দেশ, যেখানে ৫ লাখ ফ্রিল্যান্সার নিয়মিত কাজ করে কিন্তু সর্বমোট রেজিস্ট্রার্ড ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার। বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা ডিজিটাল সেলস মার্কেটিং সেকশনে বেশি কাজ করে; যেখানে ভারতের ফ্রিল্যান্সাররা টেকনোলজি অ্যান্ড সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে বেশি পারদর্শী। বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের লক্ষ অর্জনের জন্য দরকার আরো বেশি প্রশিক্ষণ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ ও ইন্টারনেট সেবা।

বাংলাদেশে বিপিও সেক্টরের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি হলো প্রডাকশন কোস্ট ইকোনোমি, কারণ আমাদের দেশের জনসংখ্যা, লেবার কোস্ট, আইটি দক্ষতা এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বাংলাদেশ পৃথিবীর ফ্রিল্যান্সিং এ নতুন হাব সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে কিছু কোম্পানি যেমন ডিউটিটেকার, জেনেক্স, এএসএল বিপিও, সার্ভিস ইঞ্জিন বিপিও, ডিজিকন টেকনোলজিস লিমিটেড বিপিও সার্ভিসের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।

বহুজাতিক কোম্পানি কোকাকোলা এবং স্যামসাং বাংলাদেশি বিপিও সার্ভিস গ্রহণ করেছে। উলেস্নখ্য যে, বাংলাদেশি মোবাইল অপারেটর্স কল সেন্টারসহ অন্যান্য কোম্পানির কল সেন্টার কনজিউমার গুডস ইন্ডাস্ট্রি এবং হসপিটালগুলো আমাদের লোকাল বিপিও থেকে সেবা গ্রহণ করছে (সূত্র: ডেইলি স্টার-২০১৭)। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং সেবা উন্নয়নের মাধ্যমে বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পস্ন্যাটফর্মে পৌঁছানো সম্ভব- যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা পাইওনিয়ারের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয় গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিপিও এজেন্সিগুলোকে ট্যাক্স ফ্রি করে দিয়েছে এবং বৈধ্য চ্যানেলে অর্থ আনলে ১০% প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কিন্তু বর্তমানে কিছু স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠী বৈধ চ্যানেল ব্যবহার না করে অবৈধভাবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয় গ্রহণ করছে যেটা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় পে-পোল অ্যাকাউন্ট খোলার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। যার কারণে লাখ লাখ ফ্রিল্যান্সার প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঝামেলার সম্মুখীন হয়। ফ্রিল্যান্সারদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা যাতে বাংলাদেশে পে-পোল অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈধভাবে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২ কোটি তরুণ ও যুব সমাজ রয়েছে। এই বৃহৎ জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার জন্য সব থেকে যুগোপযোগী উপায় হলো ফ্রিল্যান্সিং। যেখানে সামান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেকার যুবকদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানে বর্তমানে সবচেয়ে যুগোপযোগী সমাধান হলো ফ্রিল্যান্সিং। যেটা কোভিড-১৯ এর সময় আমাদের দেশের মানুষ খুব ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছে। লকডাউনে যখন লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে, তখন ফ্রিল্যান্সিং তাদের অধিকাংশ?ই-শেষ ভরসা হিসেবে সহায়তা করেছে। যেটা আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং পেশার অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা অনস্বিকার্য। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০০% ট্যাক্স ফি, বিদেশি কর্মীদের জন্য ৫০% ট্যাক্স ফি প্রথম তিন বছরের জন্য, অফিস ভাড়া এবং ইউটিলিটি বিলের ৮০% ভ্যাট ফি এবং ১০% ক্যাশ ব্যাক, এক্সপোর্ট রেভিনিউর জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রধান ক্লায়েন্ট হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের তরুণদের ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ করার আগ্রহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে; যার ফলে আমাদের দেশে বর্তমানের হাজারো ট্রেনিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং আরো যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যাতে ফ্রিলান্সিং ট্রেনিংয়ের নামে কিছু স্বার্থন্বেষীগোষ্ঠী কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে না পারে। বাংলাদেশ সরকার যদি ফ্রিলা্যন্সিং ট্রেনিং আরো সহজতর করে এবং বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য কম্পিউটার ক্রয়ের জন্য সহযোগিতা করে তাহলে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কারণ এই বৃহৎ জনসংখ্যা অবদান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক বাড়াতে পারি।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফ্রিল্যান্সারদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবুও আমাদের দেশে ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনেক ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সব থেকে বড় সমস্যা হলো গুণগত প্রশিক্ষণের অভাব এবং কষ্টসাধ্য পেমেন্ট সিস্টেম, ইন্টারনেট ও বিদু্যৎ বিভ্রাটের সমস্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এছাড়াও রয়েছে কিছু অসাধু চক্র, যারা ফ্রিল্যান্সিং কাজ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ তথ্য ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে যার জন্য বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কষ্টকর হয়। ফ্রিল্যান্সারদের স্বীকৃতি উলেস্নখযোগ্য একটি সমস্যা। পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রে ফ্রিল্যাসিংয়ের স্বীকৃতি খুবই কম। যার জন্য অনেক তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সিংয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি না পেলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আশানুরূপ ফলাফল দুরূহ হয়ে পড়বে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে অবশ্যই বেকার সমাজকে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম করে তুলতে হবে। কারণ ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভবপর। আমাদের তরুণ সমাজকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বেকার নামক অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব এবং আমরা যদি আমাদের তরুণ সমাজকে যথাযথ কাজে লাগাতে পারি; তাহলে ভবিষ্যতে ফ্রিল্যাসিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ করা সম্ভব এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান ও অন্যতম মাধ্যম।

জননেত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটাতে সহায়তা করেছেন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের ফলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নতি সাধিত হয়েছে। এর ফলে আমরা খুবই সহজে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারছি।

গুণগত মান বজায় রাখতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফ্রিল্যান্সিং বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

মো: টুটুল মোল্যা : শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে