সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

বৈশ্বিক পানি সংকটের কারণ ও প্রতিকার

নতুনধারা
  ০৩ জুন ২০২৩, ০০:০০

একথা সর্বজনবিদিত যে, পানির অপর নাম জীবন। পানিবিহীন একটি দিন কল্পনা করা আমাদের জন্য অসম্ভব। গত শতাব্দীতে, বিশ্বব্যাপী পানির চাহিদা মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীতে সব জলীয় উৎসের মাত্র ২.৫% মিঠা পানি এবং তন্মধ্যে মাত্র ১% পানিই কেবল মানুষের হাতের নাগালে। সুতরাং আমরা পৃথিবীর মাত্র ০.০০০৭ শতাংশ পানি ব্যবহার করতে পারি এবং যেটি কিনা ৬.৮ মিলিয়ন মানুষের খাবার পানির উৎস। যখন পানি সংকটের কারণে খরা দেখা যায়, এবং অজস্র মানুষ অনাহারে থাকে আর এর জন্য জীবনের অবসান ঘটে অনেকেরই। খরা-পীড়িত অঞ্চল এবং আফ্রিকা উপমহাদেশে নিরাপদ পানীয় জলের অভাব রয়েছে। সেখানকার মানুষ সাধারণত নিরাপদ পানি খুঁজতে পাড়ি দেয় কয়েক কিলোমিটার পথ। বিশ্বে বিশুদ্ধ মিঠা পানির অভাবের জন্য বেশকিছু প্রভাবক দায়ী, আর সেই প্রভাবকগুলো খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মানুষ, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর স্বাস্থ্য, এই সবকিছুকেই প্রভাবিত করে। বিজ্ঞানীরা পানির সংকটের পেছনের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে আখ্যায়িত করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়, এসবের ফলে বিশুদ্ধ পানির উৎস নষ্ট হয়ে সেখানে সংকট দেখা দেয়। উপরন্তু, অতিরিক্ত খরার কারণে সাব-সাহারার আফ্রিকার ৮০ শতাংশ কৃষিজমি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং সমুদ্রের লবণাক্ত পানির স্তর বৃদ্ধির ফলে, বিভিন্ন উৎসের পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট অনুসারে, লবণাক্ততার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জমির মোট পরিমাণ ১৯৭৩ সালে ছিল ৮৩.৩ মিলিয়ন হেক্টর, ২০০০ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ মিলিয়ন হেক্টরে, আর বর্তমানে এর পরিমাণ ১০৫.৬ মিলিয়ন হেক্টর এবং এই পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ইউনিসেফের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৈশ্বিক পানি সংকটের অন্যতম একটি কারণ। ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংগঠিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল পানি সম্পর্কিত। প্রথমত, বন্যা এবং খরা বিশুদ্ধ পানির উৎসকে ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া এবং টাইফয়েডের মতো বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। অন্যদিকে পানি সম্পদের ব্যাপারে আমাদের যথাযথ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নেই। অনেক জলপথ একাধিক দেশের সীমানাকে কেন্দ্র করে রয়েছে যেটাকে বলা হয় ডি ফ্যাক্টো শেয়ার্ড সম্পত্তি। হতাশাজনকভাবে, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর সর্বশেষ তথ্যানুসারে মাত্র ২৪টি দেশ তাদের সব আন্তর্জাতিক নদী, হ্রদ এবং ভূগর্ভস্থ জলের উৎসগুলো বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্বারা সুরক্ষিত রাখে। সুতরাং একটি দেশের পক্ষে একটি জলাভূমির কিছু অংশ পরিষ্কার রাখার জন্য সব কার্যক্রম অর্থহীন হতে পারে যদি এই জলাভূমিটির বিপরীত তীরের পানিকে পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব না দেওয়া হয়। এছাড়া পানির অপচয়, যথাযথ অবকাঠামোর অভাব এবং জোরপূর্বক অভিবাসন বা শরণার্থী সংকটও পানি সংকটের জন্য দায়ী। এমন অবস্থায় আমাদের বিশুদ্ধ পানির সংকটের সমাধানে বেশকিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রথমত, পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে, এককথায় আমাদের চলমান জীবনযাত্রায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানুষকে এই সংকট সম্পর্কে সচেতন করা এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া। এনজিও এবং সরকারকে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে যাতে সর্বশ্রেণির মানুষ, তথা একটি পরিবার, গৃহিণী থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানার শ্রমিক পর্যন্ত সবাই এ বিষয়ে সচেতন হয়। দ্বিতীয়ত, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা। জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে, পৃথিবীর কিছু অংশে ২০৩০ সাল নাগাদ জনসংখ্যার তুলনায় পানি সম্পদের চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যবধান ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হতে পারে। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অভাবী মানুষকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে হবে। তাছাড়া বর্ষাকালে কীভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হয় এবং পরে তা ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে জনগণকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী মিঠা পানির সমস্যা সমাধানে এবং বিশ্বজুড়ে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে, সরকার এবং এনজিওগুলোকে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং উত্তরণের দৃঢ় প্রয়াস চালাতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের ৬নং গোল পরিষ্কার পানি ও স্যানিটেশন অর্জনে প্রয়োজন সবার ব্যক্তি ও সামষ্টিক প্রচেষ্টা, তবেই সফলতা সম্ভব।

মো. ওবায়দুলস্নাহ

মো. সোহরাব হোসেন

গবেষণা সহকারী

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সোশ্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে