শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের দেশের ওষুধ বাণিজ্য ও ভোক্তা অধিকার

স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে যদি বাংলার মানুষ ওষুধ নিয়ে ভোগান্তিতে থাকে তাহলে সত্যি অবাক হবে বিশ্ব। বাংলাদেশের সব অর্জনের বড় অর্জন হচ্ছে নাগরিক সুবিধা, স্বাধীন জীবনযাপন, ভোক্তা অধিকার রক্ষা, ন্যায়বিচার পাওয়া।
আজহার মাহমুদ
  ১০ জুন ২০২৩, ০০:০০

বেঁচে থাকার জন্য আমাদের ওষুধ খাওয়া জরুরি। ওষুধ আমাদের সবার প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। কিন্তু এই ওষুধের প্রসঙ্গ আসলেই আমাদের দেশের মানুষের মনে নানান প্রশ্ন তৈরি হয়। এই যেমন ওষুধের দাম লেখা থাকে না ওষুধের গায়ে, একটি ওষুধের মূল্য একেক দোকানে একেক রকম দাবি করা, ওষুধের মেয়াদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনো ধারণা না থাকা থেকে শুরু করে নানা প্রশ্ন চলে আসে। সাধারণ মানুষরা এটাকে এক-প্রকার ডাকাতিও বলে থাকে।

বাংলাদেশের ফার্মেসিগুলোতে পুরো পাতা ওষুধ বিক্রি না করে তিনটা বা চারটা করে ওষুধ বিক্রির প্রবণতাও রয়েছে। আর এই প্রবণতার কারণে যে অনেক সময় ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখও অনেক সময় বুঝা সম্ভব হয় না বলে মত প্রকাশ করেছেন অনেক ক্রেতা। এতে করে মেয়াদ পার হয়ে গেলেও ওষুধগুলো ফার্মেসিতে বিক্রি হয়। যা সাধারণ মানুষের বুঝার কোনো অবকাশ থাকে না। সাধারণ মানুষের অধিকাংশের মতে, তারা জানেই না ওষুধের মেয়াদ কোথায় লেখা থাকে।

আমাদের দেশে এত ভোক্তা অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়, ভোক্তা অধিকার নিয়ে সচেতন সবাই অথচ এই ওষুধের বেলায় এলে যেন এই ভোক্তা অধিকার কোথায় হারিয়ে যায়। ওষুধের গায়ে মূল্য না থাকা যে ভোক্তা অধিকারের পরিপন্থি এটা আমরা সবাই জানি এবং মানি। কিন্তু সেটা বাস্তবে প্রয়োগ হতে আমরা দেখছি না। ভোক্তার অধিকার এই জায়গায় বারবার হরণ করা হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে পত্রিকায় রিপোর্ট করা, কলাম লেখা থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে।

গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, কোনো কারণ ছাড়াই সারা বছর ধরে বাড়ে ওষুধের দাম। প্রায় ২৪ বছর আগের একটি নির্দেশনার বলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো ওষুধের দাম বাড়ায়। বিধি অনুযায়ী দাম বাড়ানোর বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানানোর কথা। কিন্তু কোনো ওষুধের দাম বেড়েছে কিনা এমন তথ্য নেই প্রশাসনের কাছে। এমনকি প্রশাসনের ওয়েবসাইটে যে টেবিলে ওষুধের মূল্য সম্পর্কিত তথ্য থাকার কথা সেখানে নেই এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য। এভাবে কারণ ছাড়া ওষুধের দাম বাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ রোগীরা। চিকিৎসায় ব্যয় বাড়ে। ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো ভূমিকা না থাকায় কারণ ছাড়া ওষুধের দাম বাড়তে থাকে। ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রম্নয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় তালিকাবহির্ভূত ওষুধের দাম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। সেই নির্দেশনার বলে ইচ্ছমতো দাম বাড়িয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে যে কোনো ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের ছিল। '৯৪-এর আদেশের পর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধের দাম ঠিক করে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানায়। ওই দাম নির্ধারণ করার যুক্তিও তারা তুলে ধরে। ২৪ বছর ধরে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো যে দাম চাইছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সেই দামেই বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে। ফলে ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি থেকে যাচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রের বাইরে।

করোনার কঠিন সময়ে এই ওষুধ বাণিজ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। করোনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও সেসব ওষুধ অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে সবখানে। শুধু দেশে উৎপাদিত ওষুধ নয়, অভিযোগ আছে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত করোনার অতি জরুরি ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে কয়েক গুণ দামে। মানুষের জীবন যখন বিপন্ন, তখনো ওষুধ নিয়ে কিছু লোকের বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি বন্ধ হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। মানুষের জীবনের চেয়েও তারা হিসাব করছে লাভের অঙ্ক! এমন নোংরা মানসিকতা আছে বলেই আমরা আজও এত পিছিয়ে। এই অমানবিকতা কবে বন্ধ হবে সেটা আমরা বলতে পারছি না। একদিকে মানুষ টাকার জন্য ওষুধ কিনতে পারে না, অন্যদিকে কিছু মানুষ বেশি টাকার জন্য ওষুধ বিক্রি করে না। অথচ দু'জনই মানুষ। একজন ওষুধ বিক্রি করছে, অন্যজন ওষুধ ক্রয় করছে। কেউ এই ওষুধ বিক্রি করে দালান তোলেছে কেউ আবার এই ওষুধ ক্রয় করতে না পেরে জীবন হারিয়েছে।

এছাড়াও আমাদের দেশে প্রায় সময় হঠাৎ করেই দমকা হাওয়ার মতো ওষুধের দাম বেড়ে যায়। যা সাধারণ ক্রেতার জন্য বড় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব ওষুধ রয়েছে সেসব ওষুধের দাম যখন বছরে বছরে বৃদ্ধি পায় তখন সত্যি সাধারণ মানুষের বেগ পেতে হয়। ওষুধের পাতায় দাম উলেস্নখ না থাকার কারণে কিছু কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষগুলোকে চুষে খাচ্ছেন। কিছু কিছু ফার্মেসি এসব কারণে দন্ডপ্রাপ্ত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতারণা চলছে। সাধারণত ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের পাতায় মূল্য মুদ্রিত না থাকায় এই সুযোগ লুপে নেয় দোকানদাররা। ফলে দোকানদারদের মুখের কথার ওপর নির্ভর করেই সেগুলো ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে। প্রতিবার প্রতিটি ক্ষেত্রে ওষুধের প্যাকেট দোকানদারের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়ার পর মোট মূল্য দেখে সেটাকে ভাগ করে প্রতি পাতার মূল্য বের করে ওষুধ কেনা দুরূহ ব্যাপার। তাছাড়া গ্রামের মানুষ এত কিছু যাচাই করা তো দূরের বিষয়, সন্দেহও করে না। আর এই সুযোগে ওষুধের মূল্য নিয়ে প্রতারণা করছে এক শ্রেণির বিক্রেতা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি বিনীত অনুরোধ ওষুধের প্রতি পাতায় মূল্য উলেস্নখের বিষয়টি আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। এই সরকারের অধীনে এমন একটি সিদ্ধান্ত যদি সাধারণ মানুষ পায়, তবে সেটি হবে অনন্য একটি উদাহরণ।

স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে যদি বাংলার মানুষ ওষুধ নিয়ে ভোগান্তিতে থাকে তাহলে সত্যি অবাক হবে বিশ্ব। বাংলাদেশের সব অর্জনের বড় অর্জন হচ্ছে নাগরিক সুবিধা, স্বাধীন জীবনযাপন, ভোক্তা অধিকার রক্ষা, ন্যায়বিচার পাওয়া।

এসব অর্জনে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি। কিন্তু আরও অনেক অনেক এগিয়ে যাওয়া আমাদের বাকি আছে। সে জায়াগায় এই ওষুধ বাণিজ্য একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা সমাধান হলে একদিকে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।

আজহার মাহমুদ : প্রাবন্ধিক এবং কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে