সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

মত প্রকাশের অধিকার ও মানবাধিকার

মানুষ তাদের ভাবনার, কথার প্রতিফলন দেখতে চায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। সম্ভবত, সবস্তরের সমাজচিন্তক এবং রাষ্ট্রচিন্তকের দায়িত্ব মানুষের মত প্রকাশের অধিকারকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা। মানুষের অধিকারের কথা বলাই রাজনীতির, সমাজনীতির প্রধান কাজ। তাই, মানুষের জন্য রাজনীতির আদর্শই হতে পারে মানুষের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সবচেয়ে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্যয়।
ড. ফজলুল হক সৈকত
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

মানুষের মৌলিক অধিকার বলতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বুঝে এসেছি খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষাকে। কিন্তু দিনে দিনে এ তালিকা বিস্তৃত হয়েছে। বিজ্ঞানের অভাবিত আবিষ্কার, প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন, শিল্পের বিকাশ প্রভৃতির মাধ্যমে জীবনযাপনে যেমন এসেছে বৈচিত্র্য, তেমনই সামাজিক চিন্তা এবং মূল্যবোধের বিবেচনায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন ধারা ও ধারণা। 'মুক্তি' এমন একটি ধারণা। ব্যক্তির কল্পনা ও পরিকল্পনা প্রকাশের একেবারে প্রাথমিক স্তরেই এই মুক্তির অবস্থান ও বিচরণ। মানুষের মানসিক মুক্তি, শারীরিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি- এসব ধারণা গত দুই শতকে জনসমাজে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং এই মুক্তির জন্য মানুষকে সংগ্রামে, লড়াইয়ে লিপ্ত হতে হয়েছে। বহু বাধা পেরেছি বহু মুক্তি অর্জনও করেছে মানুষ। অবশ্য নানান বিবেচনায় মুক্তিলাভের পর মানুষ অনুভব করেছে নিরাপত্তার কথা। 'নিরাপত্তা' তখন অন্য একটি ধারণার জন্ম দিয়েছে। ফলে দেখা গেল, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্ত হয়েও অনেক ক্ষেত্রে মানুষ নিরাপদ নয়; নিরাপত্তাহীনতা একটি ভয়াবহ সংকট হিসেবেও দেখা দিল কোথাও কোথাও, কখনো কখনো। এভাবে মুক্তি পাওয়া মানুষ নিরাপত্তার জন্য ভাবতে আরম্ভ করল। এই যে 'মুক্তি ও নিরাপত্তা'- এগুলো খুব স্বাভাবিক ধারায়, বিবর্তনের ভেতর দিয়ে অধিকারে রূপ নিয়েছে এবং এসব ঘটেছে মানুষের চিন্তার সূক্ষ্নতম বিকাশের মাধ্যমে। তার মানে হচ্ছে- কালক্রমে মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে মুক্তি এবং নিরাপত্তা। কিন্তু বিজ্ঞানের বহু আবিষ্কারের আলোয় কিংবা আঁধারে যেমন হারিয়ে গেছে পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানীদের নাম- কাস্তে, কুঠার, কোদাল আবিষ্কারকে কেউ যেমন সাধারণত স্মরণ করে না, অনুরূপভাবে মানুষের ভাবনা থেকে দূরে সরে গেছে ভাবনা-প্রকাশের আকুতি ও কৌশলের প্রকৃত সমাচার।

এবার আসা যাক মূল সমাচারের কথায়। বনেজঙ্গলে বসবাসের সময় মানুষ প্রয়োজনের তাড়ায় খাবার সংগ্রহ করেছে ঠিকই; কিন্তু ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলার শক্তি ও কৌশল প্রয়োগের তাদের কল্পনা করতে, ভাবতে শিখিয়েছে। এই যে নিজের কথা অপরকে বলার চেষ্টা ও সুযোগ তৈরির ভাবনা, তা কিন্তু মানুষের অনন্য এক আদি আবিষ্কার। অতএব, বুঝে নিতে হবে যে, কথা বলার বাসনা ও অধিকার মানুষের একটি আদিম প্রবৃত্তি এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফসল। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নানান মৌলিক অধিকারের তালিকা সম্প্রসারিত হলেও মানুষই বারেবারে তার অন্যতম আদিম আবিষ্কার- কথা বলার স্বাধীনতা ও অধিকারকে বিপন্ন হতে দিয়েছে, কখনো-বা বিভ্রান্ত হয়েছে কিংবা মার খেতে দেখেছে। এসব ঘটেছে নেহায়েত সামাজিক তাগিদে। কথা বলার অধিকার মানে হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা; চিন্তা প্রকাশের বাধাহীন সুযোগ। এই সুযোগ, সত্যিকথা বলতে কী, অন্যান্য অধিকারের মতো সরলরেখা ধরে এগোয়নি। বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে- নিশাকালে দিশা হারিয়েছে।

মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পেরেছে বা মত প্রকাশ করতে পেরেছে বলেই মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত ও সমুন্নত হয়েছে। সমস্ত অধিকারের সাফল্য মানুষের কল্পনাকে, পরিকল্পনাকে আশ্রয় করে- চিন্তা প্রকাশের সুযোগগুলোকে নির্ভর করে দাঁড়ানোর জায়গা করে নিয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের ফলে সৃষ্টি হয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মতো বিরাটতম অর্জন। 'দু-বেলা পেট পুরে খাওয়ার' চেষ্টাকে মিথে পরিণত করে মানুষ এখন ছয় বেলা খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে। বস্ত্র-কল্পনায় মানুষ স্থাপন করেছে সাফল্যের পর সাফল্য; এমনকি এ খাতে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে বস্ত্র রপ্তানি করেও অনেক দেশ অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করেছে। মানুষ মুক্তভাবে চিন্তা করার ফলে বাসস্থান-ভাবনায় বিপস্নব সৃষ্টি করতে পেরেছে। বহুতল ভবন, পরিকল্পিত নগরায়ণ প্রভৃতির মাধ্যমে বসবাসের অধিকারে যুক্ত হয়েছে নান্দনিকতাও। লোকজ চিকিৎসার চিন্তা থেকে ধীরে ধীরে বহুধাবিভক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি মানুষ আবিষ্কার করেছে ওই চিন্তার ও মত প্রকাশের সুযোগকে আশ্রয় করেই। আবার শিক্ষা নামক মৌলিক অধিকারের ধারণাটি পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছে অনেকভাবে। যুগে যুগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে মুক্তচিন্তা লালন ও চর্চার ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। শিক্ষাভুবন সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞান। এভাবে মৌলিক অধিকারগুলো পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরতার মাধ্যমে মানুষকে উপহার দিয়ে চলেছে সুখ ও সমৃদ্ধি।

সমৃদ্ধি বা উন্নয়ন আরেকটি অভিনব ধারণা। মানুষ তার জীবনমান উন্নয়নের জন্য ক্রম-পরিবর্তন ও রূপান্তরের ভেতর দিয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায়, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায়, কর্মপদ্ধতি এবং কাঠামো পরিবর্তনে উন্নয়ন হয়েছে কল্পনাতীতভাবে। কিন্তু এত উন্নয়ন, এত সাফল্যগাথার মধ্যেও শিকড় থেকে নিজেকে উপড়ে নেওয়ার মতো বা অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মতো করে মানুষ কখনো কখনো আদি অধিকারকে ভুলে থেকেছে কোনো কোনো অবসরে বা সুযোগে ও সুবিধায়। আর, তখনই মানুষে মানুষে অধিকারের লড়াইয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভক্তিরেখা। সামাজিক ইতিহাসে এসব ব্যাপার ঘটতে দেখা গেছে সময়ের বাঁকে বাঁকে, সভ্যতার বিবর্তনের পথরেখায়।

তবে, ইতিহাসকে বাদ দিয়ে যেমন অগ্রসর হওয়া যায় না, পূর্বপুরুষকে অস্বীকার করলে যেমন নিজেকেই ভুলে থাকা হয়, ঠিক সে রকমভাবেই পূর্ব-পরিচয়কে মুছে ফেলে বা অরিজিনালিটি থেকে দূরে সরে গিয়ে সত্যিকারের অগ্রগতি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। মানুষ অধিকারের লড়াইয়ে এতটাই মশগুল, উন্নয়নের হাওয়ায় এতটাই বেহুশ যে, জাতীয় ভাবধারা এবং উন্নয়নের আড়ালে যে কখন, কীভাবে নিজের কল্পনা শক্তি থেকে ছিটকে পড়তে হয়েছে, তা অনুধাবন করার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছে এবং এ কারণেই সমাজে দেখা দিয়েছে নানান অসঙ্গতি ও বিপন্নতা। পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসে এর বহু নজির মিলবে।

এরকম একটি বহুল পরিচিত বিপন্নতার নাম ভোটাধিকার। ভোট দেওয়ার অধিকার মানে হলো মানুষের সেই আদিম- অতি আদিম কথা বলার বা ভাব প্রকাশের অধিকার। এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতারই নামান্তর মাত্র। মানুষ উন্নতি ও অগ্রগতি চায় কিনা, চাইলে কীভাবে চায়, তা সে জানাতে পারে ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে। মানুষ নেতৃত্ব চায় কিনা, চাইলে কার নেতৃত্ব চায়, তা-ও সে জানাতে পারে তার ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। এটি অত্যন্ত সাধারণ, স্বাভাবিক ও কল্পিত বিষয়। কাজেই, কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র কতটুকু অগ্রসর হলো, কতটুকু উন্নয়ন সাধন করল, মৌলিক অধিকারগুলো কতভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো- এসব প্রশ্নের সমাধান আশা করা যেতে পারে ভোটে প্রদত্ত সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে। অধিকারের প্রশ্নগুলো যত সহজে সমাধান করা যায়, জাতির জন্য ততই মঙ্গল।

বর্তমান বাংলাদেশে ভোটাধিকারের প্রশ্নে জাতি প্রায় দ্বিধাবিভক্ত। যদিও একপক্ষের ধারণা- তারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। কিন্তু অপরপক্ষ বলছেন- দৃশ্যত কিছু উন্নয়ন, বিশেষত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও মুক্তভাবে, স্বাধীনভাবে মানুষ চিন্তা ও মত প্রকাশ করার অধিকারের প্রশ্নে বিপন্ন। কোন পক্ষের অবস্থান কতটা যৌক্তিক, কাদের দাবি কতটা প্রাসঙ্গিক, সেটা নির্ধারণ করার জন্য হলেও অন্তত একটি উপায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বিতর্ক যতটা কমিয়ে সমাধানের পথ খোঁজা যায়, জাতির জন্য ততই মঙ্গল। তবে, আপাত সব সংকট থেকে মুক্তির নিরাপদ সড়ক কল্পনার আগে ভেবে নিতে হবে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার বিষয়ে চলমান প্রশ্ন ও ধারণাগুলো। মানুষ যাপিত জীবন বিষয়ে যা দেখছে, যা কিছু উপলব্ধি করছে, সেসব বিষয়ে নিজস্ব ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে চায়- পরস্পরের সঙ্গে আলাপে, প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখে ও মন্তব্য করে। সর্বোপরি,

\হমানুষ তাদের ভাবনার, কথার প্রতিফলন দেখতে চায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। সম্ভবত, সবস্তরের সমাজচিন্তক এবং রাষ্ট্রচিন্তকের দায়িত্ব মানুষের মত প্রকাশের অধিকারকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা। মানুষের অধিকারের কথা বলাই রাজনীতির, সমাজনীতির প্রধান কাজ। তাই, মানুষের জন্য রাজনীতির আদর্শই হতে পারে মানুষের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সবচেয়ে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্যয়।

ড. ফজলুল হক সৈকত :শিক্ষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে