রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

চতুর্থ শিল্প বিপস্নবে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই

মো. হাসনাইন রিজেন শিক্ষার্থী, হাটহাজারী সরকারি কলেজ হাটহাজারী, চট্টগ্রাম
  ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
চতুর্থ শিল্প বিপস্নবে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই

নয়ন আলী ভোলা সরকারি কলেজ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন ২০২০ সালে। অনেকভাবে চাকরির চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময় দীর্ঘ বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে তিনি কৃষি কাজে মনোনিবেশ করেছেন। এত পড়াশোনা করার পরও কৃষিকাজে যুক্ত হওয়ার কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে নানান আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নয়ন আলীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি দেশের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। সরকারি চাকরির একাধিক লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাইনি। প্রাইভেট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আমার পূর্বের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই বলে চাকরি দেননি। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কৃষি কাজে নামবো, তা কখনো কল্পনাও করেনি। গত তিন বছর বেকার ছিলাম। এখন আর না পেরে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছি। এতদিন বেকার ছিলাম বলে সমাজের মানুষ নানান কটূক্তি করত। এখন কৃষিকাজ করছি, তা নিয়েও তাদের মাথাব্যথার শেষ নেই। এত পড়াশোনা করে কৃষিকাজ করতে হলে পড়াশোনা কেন করলাম। তাদের এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। তাই তাদের জবাবও দিতে পারি না। কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখ ছলছল করে উঠে নয়ন আলীর। আক্ষেপ করে বলেন, যদি খেত-খামারেই কাজ করব, তবে এত টাকা-পয়সা খরচ করে লেখাপড়া করলাম কেন? এই প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পাই না। নয়ন আলীর এই প্রশ্নের সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসে। নয়ন আলীরা দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও বেকার থাকে কেন? শিক্ষাবিদরা বলবেন, লেখাপড়ার মান ভালো নয় বলে চাকরির প্রতিযোগিতার বাজারে তারা টিকতে পারেন না। তাহলে তারা স্নাতক পাস করেন কেন? একই সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসে, এই দেশে প্রতিবছর কত শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করে বের হচ্ছে? মোট চাকরির বাজার কত? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৫৮ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১০৭টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্বাবিদ্যালয়ের অধীনে ৮৫৭টি মহাবিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে সরকারি, আধা সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাচ্ছে অর্ধেকের কম। অর্থাৎ দুই লাখেরও বেশি স্নাতক পাস শিক্ষার্থী প্রতিবছর বেকার হয়ে পড়ছেন। একপর্যায়ে তাদের অনেকে হয়ত কর্মসংস্থানের খোঁজে সহায়-সম্পদ বিক্রি করে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। কেউ কেউ লেখাপড়ার অতীত ভুলে গিয়ে কৃষিকাজ কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ করছেন। তাহলে এই উচ্চশিক্ষার মানে কি? বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্প্রতি একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪৫-৫৫ শতাংশ বেকার। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পায়। ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে, কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ৯ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। বেকারদের মধ্যে অনন্যোপায় হয়ে কেউ কেউ বিদেশে চলে যাচ্ছেন, কেউ বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছোটখাটো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিসংখ্যান থেকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ পরিণতিই ফুটে ওঠে। এক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকে পরে। তারা স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করে কর্মসংস্থানের চেষ্টা শুরু করে। পরিসংখ্যান বু্যরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত বেকারের পরিমাণ ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ মোট স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই বেকার থেকে যাচ্ছে। ইকোনমিস্টের ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকার ৩০ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ এবং শ্রীলংকায় ৮ শতাংশ। ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়, জাপানের মতো উন্নত বিশ্বে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় শিক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে ৫০ ভাগের কম শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার দিকে যায়। বাকি ৫০ ভাগ স্বল্প মেয়াদে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে কাজ খুঁজে নেয়। বর্তমানে এর পরিমাণ আরও বাড়ছে। কারিগরি শিক্ষায় মেধার প্রমাণ দিতে পারলে ওখান থেকেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকে। সরকারের পক্ষ থেকেও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়া হয়। যেসব শিক্ষার্থী দ্বাদশ শ্রেণিতে ভালো রেজাল্ট করছেন, তারা উচ্চশিক্ষার জন্য মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য পড়ার সুযোগ। অপেক্ষাকৃত কম ভালো রেজাল্ট করলে তাদের পরামর্শ দেওয়া হয় কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য। আমাদের দেশেও সময় এসেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষায় নিরুৎসাহিত করে কারিগরি শিক্ষার পরামর্শ দেওয়ার জন্য।

কারিগরি শিক্ষা কী?

'টেকনিক্যাল' বা 'কারিগরি' কথাটির অর্থ হলো শিল্প প্রণালির দক্ষতা সম্পর্কিত। যে বিশেষ শিক্ষার দ্বারা এই প্রণালিগত দক্ষতা বিকাশ ঘটানো হয়, তাকে বলে কারিগরি শিক্ষা। অর্থাৎ যে শিক্ষার দ্বারা শিক্ষার্থীকে শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও কলকারখানার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেই শিক্ষাকে বলে কারিগরি শিক্ষা।

কারিগরি ও কর্ম উপযোগী শিক্ষা একটি দেশের শিল্প উন্নয়নের জন্য দক্ষ কারিগরি জ্ঞানে শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ কর্মী তৈরিতে গুরুত্ব অপরিসীম।

সমগ্র পৃথিবীতে যে দেশ যত বেশি দক্ষ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, সে দেশ তত বেশি শিল্প উন্নত। কারিগরি শিক্ষা না থাকলে জনশক্তিকে পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, কারণ বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপস্নবের যুগে জনশক্তিকে শিল্পবান্ধব জনশক্তিতে রুপান্তরের বিকল্প নেই।

উপযুক্ত ও কর্মমুখী শিক্ষা না থাকলে কোনো দেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকাসাপেক্ষেও অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করা যায় না। একইভাবে প্রচুর জনশক্তি থাকলেও কারিগরি প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা না থাকলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশের এই বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার। আমাদের দেশের এই ১৮ কোটি জনসংখ্যা হচ্ছে আমাদের অন্যতম জাতীয় সম্পদ। দেশের এক তৃতীয়াংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বল্পতম সময় দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে শ্রম বাজারের মূল স্রোতে নিয়ে আসা সম্ভব। আমাদের দেশের জনশক্তির একটি বড় অংশই হচ্ছে বয়সে তরুণ আর এটাকে কাজে লাগাতে হলে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। আমদের দেশের বিদেশগামী লোকের অধিকাংশই অনভিজ্ঞ থাকে, এতে করে তারা নিম্ন বেতনে কর্মরত হয়। এই অভিবাসী শ্রমিকদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের জীবন-জীবিকার আয় উন্নতির ব্যাপক পরিবর্তন করা সম্ভব। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হলো অভিবাসীদের রেমিট্যান্স প্রেরণ, এটাকে আমরা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে পারি শুধুমাত্র দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে। এতে আমাদের দেশের ও অভিবাসী শ্রমিকদের আয় বহুগুণে বেড়ে যাবে। পৃথিবীর অনেক দেশ কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে আমাদের চেয়েও তাদের জিডিপি অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ তারা পূর্বে আমাদের চেয়েও নিম্নগামী অর্থনীতির দেশ ছিল। তবে আশার কথা হলো, আমাদের বর্তমান সরকার ও শিক্ষামন্ত্রী এই কারিগরি শিক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ সরকার দেশের তরুণ প্রজন্মকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য অনেক ধরনের উদ্যোগ এর মধ্যে হাতে নিয়েছে।

এই বিপুলসংখ্যক জনশক্তিকে উপযুক্ত কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যমে উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করে বাংলাদেশ পা রাখবে চতুর্থ শিল্প বিপস্নবে এবং তারা অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে