বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

প্রকৃতি নয়, নিজেকে বদলান

বর্তমানে নিজে ভালো থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শান্তিময় জীবন উপভোগ করার জন্য পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা অতীব প্রয়োজন। ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেতেনতার বিকল্প নেই এবং পরিবেশ দিবসের স্স্নোগানকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগিয়ে সবাইকে পরিবেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে।
সুমন চৌধুরী
  ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
প্রকৃতি নয়, নিজেকে বদলান

পৃথিবী নামক গ্রহে বেঁচে থাকার জন্য শক্তি জোগায় পরিবেশ। আর ওই গ্রহের যে যে নির্দিষ্ট স্থানের পরিবেশের অবস্থা ভারসাম্যহীন, সেখানকার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। পরিবেশ যেমন থাকা উচিত, তেমন অবস্থা বিরাজমান নেই বাংলাদেশে, বরং অনেক নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের পরিবেশে। খুব সুন্দর ও সত্য একটা স্স্নোগান আছে, 'পরিবেশ বাঁচলে বাঁচব আমরা' অর্থাৎ যদি পরিবেশ রক্ষা পায় তাহলে আমরাও সুরক্ষিত থাকব। প্রকৃতপক্ষে, পরিবেশ বাঁচলে বাঁচব আমরা বা আমাদের দেশ সেটা স্স্নোগান হিসেবে না নিয়ে ১০০ শতাংশ বাস্তবতা বলতেই পারি। আমরা যেখানে বাস করি, যেখান থেকে শরীরের ক্ষুধা মেটাই, যেখান থেকে বেঁচে থাকার বায়ু পাই, যেখান থেকে পানি তৃষ্ণাসহ সব রকমের বেঁচে থাকার কার্যাবলি সম্পন্ন করি সেটাই পরিবেশ। পরিবেশই চেতনার সমন্বয়ক, আত্মার সক্রিয় থাকা বা জীবনীশক্তির মাধ্যম। পরিবেশের ওপর নির্ভর করেই বিকাশ ঘটে মানুষের, অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের। সৃষ্টির আদি থেকেই পরিবেশের সঙ্গে প্রাণীর মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপরেই নির্ভর করছে জড়, জীব, প্রকৃতি মোটকথা সবার অস্তিত্ব। পরিবেশ প্রতিকূল হলে জীবের ধ্বংস ও বিনাশ অনিবার্য। তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিচ্ছিদ্র সম্পর্ক। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ পরিবেশকে আমরা মানুষই নানাভাবে বিষিয়ে তুলেছি, দূষিত করে আসছি। আর পরিবেশ যদি ভারসাম্যপূর্ণ না হয়, পরিবেশে যদি নাজেহাল অবস্থা বিরাজমান থাকে তাহলে আমাদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা হবে না, এমনকি দিন দিন শুধু বেঁচে থাকাটাই ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াইতেছে বলে মনে করি। আমরাই পরিবেশ বিপর্যস্ত করি এবং পরবর্তী সময়ে আমরাই আমাদের নানারকম গুরুত্বপূর্ণ থেকে জরুরি অভাব পূরণের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করি। বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর খুব বেশি চাপের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ওই যে চিরন্তন সত্য একটা প্রবাদ আছে, 'প্রকৃতির প্রতিশোধ'। আপনি প্রকৃতির সঙ্গে যেমন আচরণ করবেন প্রকৃতিও আপনার সঙ্গে তেমন আচরণ করবে। প্রকৃতি ভালো কিছুর জন্য যেমন পুরস্কার প্রদান করে, অন্যদিকে, প্রকৃতির সঙ্গে খারাপ কিছু করলে প্রকৃতি নির্দিষ্ট সময় পর অবশ্যই প্রতিশোধ নেয়। মায়া-মমতায় ভরা এই বসবাসের জায়গা আমাদের। আমাদের প্রজন্ম এখানেই বেড়ে উঠেছে, উঠতেছে ও উঠবে। পরিবেশের ইতিবাচক দিকের বিষয় চিন্তা করে পরিবেশ দূষণ কীভাবে হচ্ছে, কীভাবে রোধ করতে পারি ইত্যাদি কারণগুলো আলোচনা করে এবং আলোচনা থেকে সঠিক শিক্ষা কাজে লাগিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্মকে এর চেয়ে উপযোগী পরিবেশ উপহার দিতে পারি।

পৃথিবীতে পরিবেশ দূষণের মাত্রা পূর্বের চেয়ে বেশি, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দ্রম্নত শিল্পায়ন, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, পস্নাস্টিকের ব্যবহার, ওজন স্তরের ক্ষয়, শিল্পকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, অত্যধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ।

বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড় বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের জন্য অন্যতম বড় সমস্যা। বেশিরভাগ মানুষই পরিবেশ দূষণের প্রথম ও প্রধান সমস্যা বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়কেই মনে করেন। একটা দেশের আয়তনের পরিমাণে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন যেখানে বর্তমান বাংলাদেশে ১৫ শতাংশ বনভূমি আছে বলেও সন্দেহ আছে। অথচ একটা সময় আমাদের দেশের প্রত্যেক স্থানেই সবুজ-শ্যামল গাছে ছিল পরিপূর্ণ। না ছিল প্রাকৃতিক জ্বালানির অভাব, না ছিল আলো, বাতাস, ছায়া ইত্যাদির অভাব। ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা দ্বিজেন্দ্র লালের কালজয়ী দেশাত্মবোধক এই গানের লাইনই বলে দেয় আমাদের পূর্বের শান্তিপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা। দুঃখের বিষয় আজ চারদিকের শ্যামল আর সবুজের জায়গায় শুধু সাদা-রঙিন ইত্যাদি আর ইত্যাদি, উন্নয়নের নামে গড়ে উঠছে বড় বড় অট্টালিকা। সবাই উন্নয়ন থেকে উন্নয়নে রূপান্তর করতে করতে ক্ষতির মহাসাগর তৈরি যে করতেছে সেটা চিন্তা করতেছে না। উন্নয়ন বিষয়টি ইতিবাচক সেটা স্বীকার করি, উন্নয়ন হওয়া উচিত সেটা জানি, উন্নয়ন হওয়ার জন্য অনেক কিছু ক্ষতি বা ব্যয়ও করতে হয় সেটাও জানি কিন্তু যে উন্নয়ন করতে গিয়ে নিজের অস্তিত্বের হ্রাস করতেছি, নিজের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মধ্যে দিন দিন ফেলে দিচ্ছি, সেই উন্নয়ন দিয়ে কী করব? আমি নিজে না বাঁচলে, আমার ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ সেটা জেনেও একরকম অপ্রয়োজনীয় উন্নয়নের কোনো মানেই হয় না। এছাড়া যথেষ্ট বৃক্ষরোপণ বা বনায়ন না করে বন উজাড়ের ফলে বাসস্থানের ক্ষতি, জৈব বিন্যাসের ক্ষতি ও অনুর্বরতা সৃষ্টি হয়েছে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিবেশগত জৈব পৃথকীকরণের ওপর এর মন্দ প্রভাব পড়েছে। সাধারণত বন ধ্বংস হয়ে যাওয়া এলাকাগুলিতে খুব বেশি ভূমিক্ষয় হয় এবং এগুলি খুব তাড়াতাড়ি পতিত জমিতে পরিণত হয়। পূর্বের কিছু সমীক্ষা বিবেচনা করলেই তা বোঝা যায়। ২০১৯ সালের তালিকায় পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের গড় স্কোর ২৯.৫৫। ২০১৬ সালের তালিকায় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪১.৭৬। প্রায় দ্বিগুণ আকারে নিচে নামছি আমরা। ২০১৪ সালের তালিকায় ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯।

জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হয়েও সুন্দরবনের সন্নিকটে এবং পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎ উৎপাদনে নির্ভরশীলতা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা ও বন সংরক্ষণের বিপরীত নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকার ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ৮০ শতাংশ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও বন নিধনের চিত্র এখনো কমেনি।

বিভিন্ন কারণে ধ্বংস করা হচ্ছে আমাদের বনভূমি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে ঘিরে ফেলা হয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি দিয়ে। যেখানে এই বনকে সুরক্ষা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা উচিত সেখানে উল্টো বিভিন্ন কারখানা বসছে এর চারিদিকে। সুন্দরবনের কাছে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত হিসেবে স্বীকৃত কয়লাভিত্তিক তাপবিদু্যৎ কারখানা প্রকল্প। এভাবেই প্রতিটি জায়গায় সবুজের সমারোহ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে চাপা পড়ে যাচ্ছে অপরাধীর নামগুলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশ বার্ষিক বন উজাড় হওয়ার হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। গত সতেরো বছরে বাংলাদেশ প্রায় ৬৬ বর্গ কিলোমিটার গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টি সহায়তাকারী বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে।

বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়ের খারাপ প্রভাব সম্পর্কে আমরা সবাই অবশ্যই অবগত আছি। তারপরও আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই 'গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান নামক' সেস্নাগান। গাছ লাগালে বাঁচবে প্রকৃতি আর প্রকৃতি বাঁচলে বাঁচব আমরা।

এছাড়া যেখানে সেখানে ময়লার আবর্জনা ফেলা, নদীতে নির্বিচারে ময়লা আবর্জনা ফেলা (বুড়িগঙ্গা নদীর কথা কল্পনা করলেই সহজে বুঝতে পারি), শিল্পকলকারখানাসহ ইত্যাদির বিষাক্ত ধোঁয়া ও বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে পরিবেশের প্রধান উপাদান মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে নদী মাতারা শান্তিতে নেই। তারা দূষিত আঘাত সহ্য করতে করতে সহ্যহীন অবস্থায় পরিণত হয়েছে। অনেক নদী বাস্তবে এখন তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদনদীর মধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। বিশেষজ্ঞরা উলেস্নখ করেছেন, গত ৪০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে বড় নদীগুলো থেকে দেশের প্রায় সব নদীতেই বিভিন্ন মাত্রায় দূষণ পৌঁছে গেছে। শিল্প বর্জ্যের ভারী ধাতু পানিতে মিশে নদীর তলদেশে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে নদীর পানিতে ক্ষতিকর ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় শূন্য পাওয়া গেছে। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না থাকলে মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব।

আপনারা জানলে খুবই অবাক হবেন যে, শুধু আমাদের অসতর্কতার কারণে দূষণ নামক সমস্যার ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ লাখ মানুষ মরছে। দূষণজনিত এ মৃতু্যতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থায় ষষ্ঠ। এ তালিকায় প্রথম অবস্থানে আছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। স্থানীয় সময় গত ১৮ মে ২০২৩ (ইংরেজি) যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট পস্নানেটারি হেলথ জার্নালে 'পলু্যশন অ্যান্ড হেলথ: আ প্রোগ্রেস আপডেট' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন (এসডিসি) ও মিনিস্ট্রি অব এনভায়রনমেন্ট অব সুইডেন এবং গেস্নাবাল অ্যালায়েন্স অন হেল্‌থ অ্যান্ড পলিউশন (গ্যাপ) ও পিওর আর্থ-এর সহযোগিতায় করা হয়েছে।

এ গবেষণা প্রতিবেদনে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণের কারণে মানবসমাজ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাবগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। 'দ্য ল্যানসেট কমিশন অন পলিউশন অ্যান্ড হেলথ' শীর্ষক একই ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। নতুন প্রতিবেদনটি মূলত সেই প্রতিবেদনেরই একটি পরিমার্জিত সংস্করণ। যেখানে বলা হয়, এ রিপোর্টটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর মাঝের এ কয়েক বছরে পরিবেশ দূষণের কারণে অকালে ঝরে গেছে বিশ্বের ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষের প্রাণ!

গবেষকরা দেখতে পান, পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ (প্রতি ৬ জনে ১ জন) প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশও দূষণজনিত মৃতু্যর তালিকার উপরের দিকেই আছে- যা দেশটির জন্য জলবায়ু হুমকির পাশাপাশি নতুন হুমকি সৃষ্টি করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে তীব্র দারিদ্র্যতার কারণে সৃষ্ট দূষণে মৃতু্যর সংখ্যা কমলে সেই অর্জন ম্স্নান হয়ে গেছে শিল্প দূষণজনিত কারণে মৃতু্য বৃদ্ধি পাওয়ায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃতু্য হয়। এর মধ্যে শুধু বায়ু দূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জনের মৃতু্য হয়। দূষণজনিত মৃতু্যর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃতু্যর কারণ পানি দূষণ। প্রতি বছর পানি দূষণে ৩০ হাজার ৮৭৪ জনের প্রাণহানি হয়। এ ছাড়া অন্যান্য দূষণজনিত মৃতু্যর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিসা দূষণ। সিসা দূষণের কারণে দেশে ৩০ হাজার ৭৭৭ জনের মৃতু্য হয়। এ ছাড়া পেশাগত দূষণে মারা যান ১০ হাজার ২৮৯ জন।

গবেষকদের মতে, দূষণে মৃতু্যতে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটিতে ২০১৯ সালে ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৬৭ জনের মৃতু্য হয়। একই সময়ে চীনে মারা যান ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৪৬০ জন- যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অন্যদিকে, একই কারণে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৭৬০ জনের মৃতু্য নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া। চতুর্থ অবস্থানে থাকা পাকিস্তানে মারা যান ৩ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ এবং ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪৪ জন মারা যাওয়া ইন্দোনেশিয়া রয়েছে পঞ্চম অবস্থানে। এর ঠিক পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।

দূষণজনিত মৃতু্যর বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গবেষকরা দেখতে পান, প্রতি বছর দূষণজনিত কারণে যে ৯০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে তার প্রায় ৭৫ শতাংশই বায়ু দূষণের কারণে। পারিপার্শ্বিক বায়ু দূষণের কারণে ২০১৯ সালে ৪৫ লাখ মানুষের মৃতু্য হয়েছে, ২০১৫ সালে যা ছিল ৪২ লাখ এবং ২০০০ সালে ছিল ২৯ লাখ। বিপজ্জনক রাসায়নিক দূষণের কারণে ২০০০ সালে মৃতু্যর পরিমাণ ছিল ৯ লাখ, সেই সংখ্যা ২০১৫ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ লাখ এবং ২০১৯ সালে ১৮ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে; সঙ্গে সিসা দূষণের কারণেই কেবল ৯ লাখ মানুষ অকালে মারা গেছে। সব মিলিয়ে, এই নিত্যনতুন ধরনের দূষণসমূহ গত দুই দশকে ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০০ সালের আনুমানিক ৩৮ লাখ মৃতু্য থেকে যা ২০১৯ সালে ৬৩ লাখ মৃতু্যতে এসে ঠেকেছে।

ল্যানসেট কমিশনের তথ্য অনুসারে, দূষণের কারণে অস্বাভাবিক মাত্রার মৃতু্য আমাদের আর্থিক ক্ষতির দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৪.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে- যা বৈশ্বিক অর্থমূল্যের ৬.২ শতাংশ। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ৯২ শতাংশ দূষণজনিত মৃতু্য এবং দূষণের কারণে আর্থিক ক্ষতির বোঝা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ঘাড়ে- যা প্রচন্ড অসমতার সৃষ্টি করছে।

পিওর আর্থ নামে দূষণ নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংগঠনের প্রধান ও গবেষণার প্রধান লেখক রিচার্ড ফুলার বলেন, জনস্বাস্থ্যের ওপর দূষণ ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে, আর এ মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবে বোঝা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ধুঁকে ধুঁকে বয়ে বেড়াচ্ছে। এতসব মারাত্মক স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মহলের দূষণ নিরসনের দিকে সে রকম কোনো নজর নেই।

তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত দূষণ প্রতিরোধ করে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অর্থ বরাদ্দ ও নজরদারি খুব সামান্যই বেড়েছে, নানা গবেষণায় দূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিও এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা বৃদ্ধি বিষয় উঠে আসা সত্ত্বেও তা নিরসনে যথেষ্ট উদ্যোগের অভাব রয়েছে।

বর্তমানে নিজে ভালো থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শান্তিময় জীবন উপভোগ করার জন্য পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা অতীব প্রয়োজন। ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেতনতার বিকল্প নেই এবং পরিবেশ দিবসের স্স্নোগানকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগিয়ে সবাইকে পরিবেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে।

আসুন পরিবেশকে টিকিয়ে রাখার যথাযথ চেষ্টা করি এবং সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন থাকবে পরিবেশ দূষণের মৌলিক কারণগুলো নির্ধারণ করে সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধানের মাধ্যমে টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। তাহলেই হয়তো সমস্যা অতিক্রম করে বসবাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।

সুমন চৌধুরী : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে