রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির আবেগ-অনুভূতির ধারক

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
  ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির আবেগ-অনুভূতির ধারক

৭ মার্চের ভাষণ সব স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য এক প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ- যার প্রতিটি শব্দ এক একটি পুস্তকসম। এ ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়, স্বাধীনতার প্রস্ততি নেয়, যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়, প্রাণ বিসর্জন দেয়, চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে নেয়। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ তারিখে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এতদাঞ্চলের মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি '৪৮ থেকে শুরু করে '৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে আর দেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে শামিল হয়ে ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সময় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পড়তে; তিনিই হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উদ্বেলিত মহাসমাবেশে বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধুর সেই তেজোদীপ্ত উচ্চারণ- 'এবারের সংগ্রাম আমদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সেই ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষের নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অন্যায়ভাবে এবং বিনা কারণে বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, গুলি ও রক্তপাত করা হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা সমঝোতা না করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে হতাহত করেছে। এরূপ রক্তের করুণ ইতিহাস পুরা পাকিস্তানি শাসনকাল জুড়ে বিরাজমান ছিল। সর্বোপরি ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে জাতির পিতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ২৩ বছর যাবত পাকিস্তানি শাসকদের বাংলাদেশের মানুষের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন- যা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মানুষের স্বেচ্ছায় যোগদান এবং দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বৃদ্ধ, শ্রমজীবী সবার সহযোগিতা করার প্রয়াস পেয়েছে।

জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের পরই মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভাজন এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভু্যদয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় ও সমগ্র জাতি স্বাধীনতার জন্য দিকনির্দেশনা পেয়ে যায়। সমগ্র জাতি দেশ স্বাধীন করার নিমিত্তে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এ প্রস্ততির মধ্যে মানসিক প্রস্তুতি, যুবসমাজকে সংঘটিত করা, অস্ত্র সংগ্রহ, যুদ্ধযাত্রা, প্রতিরোধ করার অভিপ্রায়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। যা পুলিশ বাহিনী, সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯৭১ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ কর্তৃক প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ এ নির্দেশনার ফলস্বরূপ।

বঙ্গবন্ধু বাংলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখন্ড এবং ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ার। তিনি এক সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে তিনি তৈরি করবেন দক্ষ মানবসম্পদ আর যারা হবে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান, সুশিক্ষিত নাগরিক। একটি সামাজিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে নিউজ উইক ম্যাগাজিন ওদের একটি কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং বলে আখ্যায়িত করে।

বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেছেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। তিনি বলেছেন, বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর নির্বাচন, '৫৮-এর সামরিক শাসন, '৬৬-এর ছয় দফা, '৬৯-এর গণ-অভু্যত্থান, '৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিদের বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন; অন্যদিকে, যুদ্ধকৌশলও বলে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, যদি যুদ্ধ হয়, তবে বাঙালিরা যেন বর্ষাকালকে বেছে নেয়, যুদ্ধের জন্য। কিন্তু পাকিস্তানিরা এ বক্তৃতার সারমর্ম বুঝতে পারেনি; বরং তৎকালীন চধশরংঃধহ ঈযরবভ গধৎংযধষ খধি অফসরহরংঃৎধঃড়ৎ বলেছিলেন, 'ঞযরং রং :যব নবংঃ ংঢ়ববপয ঁহফবৎ :যব পরৎপঁসংঃধহপবং.'

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা মুক্তিকামী মানুষের কাছে লাল-সবুজ পতাকাকে মূর্তিমান করে তোলে। আর এরই মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়। সাংবাদিক শেরিল ডান বলেছেন, 'বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলেন একমাত্র নেতা; যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে এবং জন্মে একজন পূর্ণাঙ্গ বাঙালি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অসীম। তার কণ্ঠ বজ্রকঠিন। তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বে সহজেই আবিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। তার সাহস এবং অনুপ্রেরণা শক্তি তাকে এ সময়ের অনন্য সেরা মানবে পরিণত করেছে।'

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল- যা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের মহামূল্যবান দলিল (ডকুন্টোরি হেরিটেজ) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার সঙ্গে 'মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডবিস্নও) এ ভাষণটি সসম্মানে সংগৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রকারান্তরে জাগিয়ে তুলেছিল বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন। আজো ভাষণটি শুনলেই শরীরের ভেতর কেমন যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তনুমনে রক্তধারা টগবগিয়ে ওঠে। প্রেরণা জোগায় স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর অবদান। তার অনন্য সাধারণ বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে একসূত্রে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'- ছিল মূলত নিপীড়িত-নিষ্পেষিত বাঙালির পক্ষে স্বাধীনতার ডাক। ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই জ্বালাময়ী ভাষণের ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন-সাধ-স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৎকালীন সময়ে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি আমাদের প্রিয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তখন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঘোষণা প্রদান করেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া : উপাচার্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে