সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেন সবার আগ্রহ প্রশাসন ক্যাডারের চাকরি

দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে ৫৩ বছর আগে। এই ৫৩ বছরেরও ব্রিটিশদের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যটি রাষ্ট্র পরিচালনা যন্ত্র থেকে দূর করা যায়নি- যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর পরির্বতন ঘটানো, যাতে করে দেশি মেধা বিদেশে পাচার না হয়।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

সম্প্রতি সরকার 'বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) গঠন ও ক্যাডার অধ্যাদেশ-২০২৪' জারি করেছেন। এর ফলে 'বিসিএস (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুল-১৯৮০ বিলুপ্ত হলো। তবে বর্তমানে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস রুলের তফসিলভুক্ত ৩ হাজার ৯৭টি পদকে দ্বিগুণ করে ৭ হাজার ৭৬টি পদ সৃষ্টি করা হয়। এই প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সরকারি চাকরিজীবীদের কর্মকর্তা বলতে হবে। অপরদিকে, জেলা পর্যায়ের প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদটি হলো ডিপুটি কমিশনারের। এখন থেকে ডেপুটি কমিশনারের পরিবর্তে জেলা প্রশাসক বলার নিয়ম করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, এর অর্থ সাধারণভাবে বুঝায় যে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ- মানে প্রজারা। যেহেতু বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ, তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এর পক্ষে দেশটি পরিচালনা করবেন। নিয়মানুসারে রাজকোষের মালিক জনগণ, তাদের সেবার জন্য কাজ করবে প্রশাসন।

জনগণের অর্থ দিয়ে বেতন-ভাতা প্রাপ্তকর্মীরা কি করে কর্মকর্তা হয়? তাছাড়া সাংবিধানিক মতে, সরকারি চাকরিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে পরিচিত। আইন ও অন্যান্য নিয়োগ বিধিতেও কর্মচারী শব্দটি বহাল আছে। জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে কর্মকর্তা শব্দটি মূলত আইন ও বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটি শব্দ বলে প্রতীয়মান হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা জনপদটি দখল করার পর, ভূমি রাজস্ব আদায়ের নিমিত্তে সমগ্র বাংলাকে (পশ্চিম বাংলা ভারতের ও বাংলাদেশ) ২৮টি ডিস্ট্রিকে বিভক্ত করে। এই ডিস্ট্রিকই জেলা হিসেবে পরিচিত। জমিদারদের কাছ থেকে খাজনা নেওয়ার জন্য কোম্পানি কালেক্টর নিযুক্ত করেন। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিং জেলা কালেক্টরের পদ সৃষ্টি করেন। তৎকালীন সময়ে রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়টি পৃথক ছিল প্রশাসন থেকে। রাজস্ব আদায়টি প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ ছিল না। মূলত ব্রিটিশরা রাজস্ব আদায়ের জন্য সৃষ্ট জেলা কালেক্টর পদটি এক সময় জেলার মুখ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা বানায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর, কিছু জমিদার খাজনা আদায় করার জন্য নেটিভদের (বাংলা জনপদের মানুষ) ওপর অত্যাচার শুরু করে। তখন নির্যাতন নিরোধ বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় এই কালেক্টরদের। অপরদিকে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটা সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। যার জন্য বাংলা জনপদের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে ও প্রজাদের কাছ থেকে সহজভাবে জমিদাররা যেন খাজনা আদায় করতে পারে তাও দেখার দায়িত্ব দেন ইংরেজ সরকার এই কালেক্টরদের। তখন তারা কিছু ফৌজদারি কার্যক্রম চালানোর ক্ষমতা পায়। আর এই ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে এদের বলা হয় ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট। থানা বা পুলিশের জন্ম ইতিহাসটাও খুব সুখকর নয়। কৃষক বিদ্রোহ দমন এবং জমিদারের বা ভূমি মালিকের কাজে সহায়তা প্রদান এবং প্রজাদের জমিদারের অধীনস্থ করার লক্ষ্যে পুলিশি ব্যবস্থার সৃষ্টি হয় বাংলা জনপদে। যদিও বর্তমানে পুলিশি ব্যবস্থারই নানা পরির্বতন হয়েছে। তবে জেলা কালেক্টর যা, এখন ডিসি তা পুলিশি ব্যবস্থাটির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।

ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। পকিস্তানি শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের এক রক্ষক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে স্বাধীন হয়। তবে ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি শাসন ব্যবস্থার কোনো পরির্বতন হলো না। ব্রিটিশদের চেয়ে বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয় প্রশাসনের হাতে। আমলাতান্ত্রিকতা ঝেঁকে বসে রাষ্ট্র পরিচালনা যন্ত্রে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল প্রশাসনের দৌরাত্ম্য কিছুটা হলেও কমবে কিন্তু তা কমেনি, বরং দিন দিন তা বাড়ছে। স্বৈরাচার এরশাদের আমলের চাইতে এখন আমলারা বেশি ক্ষমতা ভোগ করেন। তাই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষে দেশের প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মচারী (যদিও বর্তমানের প্রজ্ঞাপনে বলতে হবে কর্মকর্তা) হতে চায়। কারণ প্রতিটি মানুষ চায় ক্ষমতা আর পদমর্যাদা। জেলা পর্যায়ে যারা প্রকৌশলী, সিভিল সার্জনের দায়িত্ব পালন করেন তারা শিক্ষা জীবনে যথেষ্ট মেধাবী, কিন্তু তাকে জবাবদিহি করতে হয় জেলা প্রশাসকের কাছে। এ জন্য দেখা যায় যে, বুয়েট, রুয়েট বা কোনো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর শিক্ষার্থীটি আর তার পঠিত বিষয়ের বিভাগগুলোতে চাকরি করতে চান না। শিক্ষার্থীটির মূল প্রত্যাশা থাকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মী হওয়ার। বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরতদের সিংহভাগের একাডেমিক রেকর্ড খুঁজলে দেখা যাবে যে, তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড কৃষি, প্রকৌশল ও চিকিৎসা শাস্ত্রের। কেন এমন হচ্ছে, বিষয়টি সবার বুঝা দরকার। কৃষি, চিকিৎসা ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা ব্যবস্থা রাখার উদ্দেশ্যই হচ্ছে দেশের সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নয়ন ঘটানো। তাদের শাসক বানানোর জন্য নয়। এরা প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেওয়ার মূল কারণ হলো, যথাযথ সম্মানের অভাবে প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিষয়ভিত্তিক দপ্তরে তারা চাকরি করতে অনীহা প্রকাশ করে। ২০১৮ সালে দেশের ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয়ের এক হিসেবে দেখা গেছে, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গড় ব্যয় বেশি। শেখ মুজিব মেরিটাইম ইউনির্ভাসিটির ব্যয় সর্বাধিক। এখানে শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৭০২ টাকা ২৬ পয়সা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৪ টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৯০২ টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। সরকার বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি ব্যয় করার পেছনের মূল কারণ হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আহরিত জ্ঞান যেন কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারে। এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা যখন প্রশাসন, পুলিশ, আবগারী শুল্ক, সাবরেজিস্ট্রার ক্যাডারে ঢুকে যায় তখন তারা তাদের একাডেমিক লব্ধ জ্ঞানকে আর কাজে লাগাতে পারে না। ফলে রাষ্ট্রের ব্যয়কৃত অর্থ জনগণের কোনো কাজে আসে না। রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অধিক টাকা ব্যয় করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও কৃষিবিদ বানানোর পর এরা রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখছে না। দেখা যায়, দু'জন কৃষিবিদ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্র্ণ হলো। একজন বিসিএস (কৃষি) অন্যজন বিসিএস (প্রশাসন)। যিনি প্রশাসনে চাকরিতে প্রবেশ করলেন তিনি যে সময় চাকরি করে জেলা প্রশাসক পদমর্যাদার কর্মকর্তা হয়ে যান। তার সতীর্থ বন্ধুটি কৃষি ক্যাডারে চাকরিতে তখন মাত্র উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পদটি পান। অপরদিকে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বিসিএস পরীক্ষায় দিয়ে ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে পারেন না, কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে যারা বিসিএস পাস করেন তারা নিশ্চিত সচিব হয়ে অবসরের যান। এ ধরনের বৈষম্য থাকার জন্য চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রকৌশল ও কৃষি ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা থাকেন হতাশায়। এই হতাশার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়ন হয় না। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের উচিত নতুন বিধান চালু করা, যে যে ক্যাডারে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করবে তাকে এই কাডারের সর্বোচ্চ পদটি (সচিব) পদোন্নতির সুযোগ করে দিতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারের ছড়ি ঘুরানোর বিষয়টি সব বিভাগ থেকে কমিয়ে ফেলা দরকার। বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে যারা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে তারা সব বিভাগের সঙ্গে শুধু সমন্বয় সাধন করবেন। দেশ এখনো সেই ঔপনিবেশিক আমলের ধারাটি বজায় রাখার জন্য প্রকৃত মেধাবীরা রাষ্ট্রের জন্য অবদান রাখতে পারছে না। বাংলাদেশের চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানবিষয়ক বিষয়ে পান্ডিত্য জ্ঞানধারী এখন বিদেশমুখী। দেশের অভ্যন্তরে তারা নিজেদের লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতে গিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কাছে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই তারা দেশের বাইরে কর্মক্ষেত্র খুঁজে নেন। দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে ৫৩ বছর আগে। এই ৫৩ বছরেরও ব্রিটিশদের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যটি রাষ্ট্র পরিচালনা যন্ত্র থেকে দূর করা যায়নি- যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর পরির্বতন ঘটানো, যাতে করে দেশি মেধা বিদেশে পাচার না হয়।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে