শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এ আর্তনাদের শেষ কোথায়?

সালেহ আরাবী শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
  ১৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

ফিলিস্তিন; ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত জনপদগুলোর মধ্যে একটি। ইহুদি আগ্রাসনের শিকার গাজা ও পশ্চিম তীর, বিশেষত হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার অবস্থা পৃথিবীর মানবতাহীন উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত খাদ্য সংকট, জ্বালানি, গ্যাস ও বিদু্যৎ সংকট এ জনপদের অধিবাসীদের নিত্যসঙ্গী। সেই সঙ্গে বোমা হামলা, স্থল ও আকাশ পথে আক্রমণ, নারী ও শিশু হত্যা বরাবরের মতো চলছেই। সোস্যাল মিডিয়ায় দুটি ফটো ও দুটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। একটি ফটোতে খাদ্যাভাবে একটি শিশু পেটে পাথর বেঁধে রেখেছে, দ্বিতীয়টিতে না খেতে পেয়ে কংকালসার হাড্ডি হয়ে মারা গেছে ফিলিস্তিনি শিশু। ভিডিওর একটিতে একজন মা তার ছোট দুই শিশুর লাশ হাতে আর্তনাদ করছে। অন্যটিতে দেখা যাচ্ছে তীব্র খাদ্য সংকটে মা তার নিজের বুকের দুধ পর্যন্ত সন্তানকে খাওয়াতে পারছে না। খেজুর পানিতে ভিজিয়ে খেজুরের রস খাওয়াচ্ছে! কতটা অসহনীয় দৃশ্য। শুধু এ দু-তিনটি দৃশ্য নয়; এমন হাজারো চিত্রের সাক্ষী আজ গোটা ফিলিস্তিন। গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা। আর আমরা সারাবিশ্বের ঘুমন্ত বিবেকের কিছু মানুষ। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। গাজার উত্তরাঞ্চলের মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। জ্বালানি, খাদ্য, বিদু্যৎসহ সব ধরনের সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল। একটি পয়েন্ট দিয়ে ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকছে তবু ডানপন্থিদের আন্দোলনের কারণে সেটাও অনিশ্চয়তায় পর্যবষিত হয়েছে। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে হামাস জয়লাভ করলে, ইসমাইল হানিয়া সরকার গঠন করে। কিন্তু পশ্চিমা ও ইসরাইলি মদদে প্রেসিডেন্টমাহমুদ আব্বাস সে সরকারকে পদচু্যত করে এবং ফাতাহ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটালে হামাসও বল প্রয়োগে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তখন থেকেই মূলত, গাজা হামাসের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিম তীর ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে আছে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘে কর্তৃক দ্বি-রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ইসরাইল মানেনি। অতঃপর প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালের প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, তারপর ১৯৬৭ এবং সর্বশেষ ১৯৭২ সালের সর্বশেষ যুদ্ধেও পরাজয়ের পর আরবরা আর ইসরাইলের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেনি। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইলের যুদ্ধের পর সর্বত্র হতাশা নেমে আসে এবং ফিলিস্তিনি যুবকদের মধ্যে যুধ্বংদেহী মনোভাব জন্ম নেয়। জর্ডানে বসবাসরত ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মধ্যে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন জোরদার হয়। ফলে ১৯৫৮ সালে ইয়াসির আরাফাত নেতৃত্বে ফাতাহ প্রতিষ্ঠা হয় এবং ১৯৮৭ সালের ইন্তিফাদার পর প্রতিষ্ঠিত হয় হামাস। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। ইয়াসির আরাফাত কূটনীতি এবং শান্তির পথে ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের প্রয়াসী ছিলেন এবং এ কারণে তার প্রচেষ্টায় অসলো শান্তিচুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু হামাস প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জনে বিশ্বাসী ছিল এবং ইসরাইল রাষ্ট্রকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। আজ অবধি তাদের এই ধারা অব্যাহত আছে। হামাসের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি শাইখ আহমাদ ইয়াসিনসহ অনেককে হত্যা এবং হত্যা চেষ্টা করে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। এমনকি গাজায় বারবার আক্রমণ পরিচালনা করেও তারা হামাসকে দমাতে ব্যর্থ হয়। শত আক্রমণের পরও ফিনিক্স পাখির মতো আবার জেগে ওঠে হামাস।

গত বছরের ৭ অক্টোবর জেরুজালেমে 'অপারেশন আল আকসা ফ্লাড' নামে প্যারা-গস্নাইডার অপারেশন পরিচালনা করে হামাস। ইসরাইলের 'আয়রন ডোম' প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও গুঁড়িয়ে দেয় তারা। মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি এবং সারাবিশ্বের মুসলমান তাদের এ বিজয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, হামাসই পারবে জায়নবাদী ইসরাইলের সঙ্গে লড়তে, মুখোমুখি হয়ে পাল্টা জবাব দিতে। হয়তো বিজয় ছিনিয়ে আনতে। তবে গাজার বর্তমান অবস্থা অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে অধিক শোচনীয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বোমা হামলা, নারী ও শিশুদের লাশের মিছিল। আহতদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থাও সীমিত। চারদিক থেকে সাহায্যের ব্যবস্থাও বন্ধ।

মোটকথা, এ জনপদ এবং গোটা ফিলিস্তিনের মানুষের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস পর্যন্ত গুমট হয়ে আছে। সবদিক থেকে অবরুদ্ধ এ জনপদের বাসিন্দাদের হাহাকারের শেষ কোথায়? মা-বাবা হারানো অবুঝ সন্তানের আর্তচিৎকার আর কত শুনতে হবে? স্বামী-সন্তান হারা নারীর শোকের মাতম কে থামাবে? ক্ষুধার্ত সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে না পারা মায়ের অসহায়ত্ত কবে শেষ হবে? বুকে পাথর বেঁধে রাখা শিশুর খাবারের ব্যবস্থা কবে হবে? খাবার দুধ না পেয়ে মারা যাওয়া শিশুদের লাশের মিছিলের শেষ কোথায়? মা-বাবার কবরের ওপর অবুঝ শিশুর বোবাকান্না আর কত দেখতে হবে? বিশ্বের মানুষের ঘুমন্ত বিবেক জাগার মতো সময় কি আজো হয়নি। জবাব জানা নেই কারও, তবে আশার কথা, ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনতা জেগে উঠবেই এবং তাদের হাতেই রচিত হবে নতুন ইতিহাস।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে