সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বঙ্গোপসাগরকে দূষণমুক্ত রাখা জরুরি

বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ কাজে লাগিয়ে মাঝখান থেকে নিজেদের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করায় উদ্যোগী হতে পারবে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী ক্ষুদ্র দেশ ও জাতিগুলো। তার জন্য সবাইকেই উদ্যোগী হতে হবে, যাতে বজায় রাখা সম্ভব হয় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। আর দরকষাকষির মাধ্যমে বাংলাদেশকেও তার ন্যায্য হিস্যা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে হবে। এই বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলের অঢেল সম্পদই বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বে উত্তরণে অসামান্য অবদান রাখবে।
অমল বড়ুয়া
  ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

বর্তমান সময়ে বঙ্গোপসাগরের ক্রমাগত দূষণ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ বা তার কাছাকাছি মাসগুলোতে দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগর থেকে আসা বায়ুদূষণ মেঘ বঙ্গোপসাগরের ওপর জমা হয়। যার মধ্যে যানবাহনের ধোঁয়া, রান্নাবান্নায় নির্গত ধোঁয়া এবং শিল্প-কারখানার ধোঁয়া অন্যতম। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) তথ্যমতে, নদীর মাধ্যমে দূষিত হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। ভারত ও মিয়ানমার থেকে দেশের ১৮টি আন্তঃসীমান্ত নদীতে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ৩৪৫ টন একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিক প্রবেশ করে। এর মধ্যে ২ হাজার ৫১৯ টন পস্নাস্টিক ভারত থেকে এবং ২৮৪ টন মিয়ানমার থেকে আসে। বছরে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন টন পস্নাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরের পানিতে জমা হয়। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে বছরে ২০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি পস্নাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে এসে পড়ছে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভূটান থেকেও এসব পস্নাস্টিক বর্জ্য এসে পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক অর্থনীতির এ অঞ্চলটি নিয়ে এরই মধ্যে নানা শংকা দেখা দিয়েছে। দেশি-বিদেশি পস্নাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব বঙ্গোপসাগর। শিল্প ও মানববর্জ্য তো আছেই, এর বাইরে নদীপথে ঢুকছে ৩০০ ধরনের পস্নাস্টিক বর্জ্য। আর সমুদ্রগামী জাহাজের তেল দূষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন নদ-নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া টনকে টন পস্নাস্টিক বর্জ্য হজম করছে বঙ্গোপসাগর। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড এলাকায় জাহাজ ভাঙার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের দূষণ, কর্ণফুলীর মোহনা ও বহির্নোঙর জুড়ে তেল দূষণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চট্টগ্রাম উপকূলে সামুদ্রিক মাছসহ জীববৈচিত্র্য দ্রম্নত হারিয়ে যাচ্ছে, পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে। যে হারে দূষণ বাড়ছে তাতে সাগরের বিশাল এলাকা অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাগরের কুকে পেট্রোলিয়ামবাহী ট্যাংকার চলাচল, বন্দরে তেল খালাস ও বোঝাইকরণ প্রক্রিয়া এবং পেট্রোলিয়াম প্রক্রিয়াজাত কারখানাসমূহ থেকে নির্গত অপদ্রব্য প্রভৃতির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পেট্রোলিয়ামজনিত দূষণ ঘটে থাকে। কর্ণফুলী, পশুর ও বুড়িগঙ্গা নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পয়ঃনিষ্কাশনের ফলে সাগরে জৈব-রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা-বিওডি অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বঙ্গোপসাগরে বিওডি-র রেকর্ড দূষণ বিস্তারকেই নির্দেশ করে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ শিল্পবর্জ্য, কৃষি অবশেষ ও কীটনাশক, অন্যান্য মানবীয় কর্মকান্ড; যেমন : নির্বিচারে উপকূলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস, উপকূলীয় চিংড়ি চাষের অপরিকল্পিত সম্প্র্রসারণ প্রভৃতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সামগ্রিক প্রতিবেশগত অবনতি সাধিত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য আহরণ এবং উপকূলে মৎস্যবর্জ্য নিক্ষেপ বঙ্গোপসাগরের সমৃদ্ধ মৎস্যক্ষেত্রসমূহের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাগরে লবণের মাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্য সংকট, আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলেও জীববৈচিত্র্য মারা যেতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার উপকূল পর্যন্ত স্থানে সমুদ্রের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটার পানিতে স্থানভেদে ৫ মিলি গ্রামের নিচে নেমে যাচ্ছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ৩-এর নিচে নেমে গেলে জলজপ্রাণি মারা যাবে। জাতিসংঘ পরিবেশবিষয়ক প্রোগ্রামের তথ্যমতে, 'সামুদ্রিক দূষণ হলো বিষ, যান্ত্রিক অ্যাসিফিক্সিয়া বা অন্যদের দ্বারা বিপুলসংখ্যক সামুদ্রিক জীবের মৃতু্যর প্রত্যক্ষ কারণ। এর একটি উদাহরণ প্রবাল প্রাচীরের অন্তর্ধান। কারণ প্রবাল পলিপগুলো দূষণের জন্য খুব সংবেদনশীল। একইভাবে, শক্ত বর্জ্য এবং ইউট্রোফিকেশন দ্বারা সমুদ্রের উপকূলে দূষিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির অপসারণ বা মুতু্য ঘটে। তিনি বলেন, দূষিত সৈকতে স্নান করার সময় ত্বকের সমস্যা হতে পারে। দূষিত পানির কারণে সামুদ্রিক মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দূষিত বর্জ্য মাছের পেটে যাচ্ছে।'

বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে কর্ণফুলী, হালদা, মাতামুহুরী, বাকখালী, নাফ, কাচালং, চিংরি, মায়ানি নদী প্রবাহিত। আর এসব নদী দিয়ে যাচ্ছে দূষিত বর্জ্য। প্রতিদিন হাজার হাজার টন বর্জ্য হজম করছে বঙ্গোপসাগর। কর্ণফুলীর পাড় ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন বৃহদাকার সার ও রাসায়নিক কারখানাসহ হাজার হাজার ছোট-বড় শিল্প-কারখানা। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একদল গবেষক বঙ্গোপসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত চালানো জরিপে সাগরের পস্নাস্টিক বর্জ্যের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। জরিপ শেষে গবেষক দলের উপনেতা হিথার কোল্ডেওয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে উলেস্নখ করেন, 'বঙ্গোপসাগরের দূষণে প্রধান ভূমিকা রাখছে পস্নাস্টিক বর্জ্য। প্রতিবছর প্রায় ৯০ লাখ টন পস্নাস্টিক পণ্য নদীতে গিয়ে পড়ে। এসব পণ্য ভেসে ভেসে সাগরে গিয়ে পড়ছে।' জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি'র মতে, 'বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন পস্নাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক দিয়ে যা বিশ্বে পঞ্চম।' বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বুরি) সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, বঙ্গোপসাগরে বর্তমানে যে ভয়াবহ পস্নাস্টিক দূষণ হচ্ছে তাতে সাগরটি ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে পানিতে মাইক্রোবায়াল পলিউশন বা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূষণ বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশের পর্যটনশিল্পও হুমকির মুখে পড়তে পারে। গবেষকরা পরীক্ষা করে সৈকতের পানিতে এবং সৈকত থেকে এক কিলোমিটার দূরের পানিতেও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পান। পর্যটক মৌসুমের সঙ্গে সাধারণ সময়ের তফাৎ দেখা গেছে পর্যটন মৌসুমে ৬৩ শতাংশ এবং সাধারণ সময়ে ৩৭ শতাংশ।

নিউ ইয়র্কভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির তথ্যমতে, গত দুই বছরে দেশের বিভিন্ন সাগর উপকূল ও নদীপথে ৬১টি ডলফিন ও ৬টি তিমি মরা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে। দেশি-বিদেশি সমুদ্র বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বঙ্গোপসাগরে পস্নাস্টিক বর্জ্য দূষণ বন্ধ না হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই নদী ও সাগরের দূষণরোধে কার্যকর পরিকল্পনা ও তার টেকসই বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া দূষণরোধে যুগপৎ সরকার ও জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিশাল সমুদ্রের সুনীল জলেই বিরাজমান আমাদের জাতীয় উন্নতি। এই সমুদ্রসম্পদের বিজ্ঞানসম্মত আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতিতে রূপান্তরে অনন্য ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া, এই সমুদ্র জলেই নিহিত আছে আমাদের জাতীয়তাবাদ ও ভূ-রাজনীতির শক্তি, সক্ষমতা ও গুরুত্ব। আর বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে ওঠার চলমান প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থাকবে আগামী দিনেও। তাতে নিয়ামক থাকবে জ্বালানি নিরাপত্তা, যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ। বঙ্গোপসাগরের রয়েছে অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা। অনেকগুলো পক্ষ এর সঙ্গে জড়িত। বিশ্লেষকদের অভিমত, অর্থনীতির ভরকেন্দ্র পশ্চিম থেকে ক্রমেই সরে আসছে পূর্বদিকে।

বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ কাজে লাগিয়ে মাঝখান থেকে নিজেদের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করায় উদ্যোগী হতে পারবে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী ক্ষুদ্র দেশ ও জাতিগুলো। তার জন্য সবাইকেই উদ্যোগী হতে হবে, যাতে বজায় রাখা সম্ভব হয় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। আর দরকষাকষির মাধ্যমে বাংলাদেশকেও তার ন্যায্য হিস্যা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে হবে। এই বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলের অঢেল সম্পদই বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বে উত্তরণে অসামান্য অবদান রাখবে।

অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে