হাজারখানেক নদীর দেশ আমাদের সুজলা-সুফলা ছোট্ট এই বাংলাদেশ। নদী বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম একটি নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের প্রতিটি জেলায়, পাড়া-মহলস্নায় ছড়িয়ে আছে কোনো না কোনো নদীর অস্তিত্ব। এ দেশের নদীর নামগুলোও বেশ নান্দনিক। যেনো একেকটা নদীর নাম একেকটা শিল্প সফল কবিতা। যেমন : পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, শীতলক্ষ্যা, তিস্তা, তুরাগ, তিতাস, মাতামুহুরি, কপোতাক্ষ, কর্ণফুলী, ইছামতি, মধুমতী, ইত্যাদি। নন্দনতত্ত্বের বিচারে এ দেশের সৌন্দর্যের ধারক-বাহকের প্রধান অনুসঙ্গ নদী ও নারী।
বাংলাদেশের জনজীবনের অন্যতম ধারক ও বাহক এই নদীগুলো। এগুলো কেবল জলের স্রোতকে সাগরের পদপানে বয়ে বেড়ায় না, বয়ে বেড়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন ও জীবিকার চাকা। নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্ণীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রামের মতো উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবনের জীবিকার প্রধান উৎস এই নদী। এসব উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেরা নদীতে কারেন্ট জাল, বিন্তি ও বড় জাল ফেলে নৌকা, ট্রলারের মাধ্যমে নদী থেকে নানাবিদ মাছ আহরণ করে। আহরণকৃত মাছ নিজেরা খায়। এমনকি, শহরে বাজারে বিক্রি করে তাদের জীবিকার চাকা সম্মুখে আবর্তিত করে। এ দেশের ফুল ও ফসলের প্রধান ধারক বাহকও নদী। নদীর পলি মাটির বুকে কৃষাণ করে সব সোনাঝরা ফসলের আবাদ। নদীর জলের সেচ ছাড়া এ দেশের কৃষির কল্পনা করাও অসম্ভব। নদী বাংলাদেশের নিম্নবর্গীয় জেলে, কৃষক, শ্রমিক, এমনকি ধনিকশ্রেণির জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্রষ্টার সীমাহীন অনুকম্পা হয়ে।
বাংলাদেশের নদীগুলো সাহিত্যের সঙ্গেও সুগভীরভাবে সম্পৃক্ত, বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখার সহিত রয়েছে এই নদীগুলোর অনিন্দ্য সুন্দর সখ্যতা। যা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে সুমহান মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। পদ্মা নদীর মাঝি- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি কালজয়ী উপন্যাস। এটি বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। বিদেশি ভাষায় সর্বাধিক অনুদিত। কুবের, কপিলা, হোসেন মিয়া, ধনঞ্জয়, গণেশ, গোপী প্রভৃতি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটে উঠে নদীমাতৃক তৃণুষের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম ও বৈচিত্র্য। সুবিশাল পদ্মানদীর পাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকা কেন্দ্রীক এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এ ছাড়া তিতাস একটি নদীর নাম- বাংলা সাহিত্যে নদী উপাখ্যানে আরেক কালজয়ী সংযোজন। অদ্বৈত মলস্নবর্মণ এখানে জলচর মানুষের জীবন-জীবিকার চিত্র নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করেছেন। বিশ্ব সাহিত্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার বিখ্যাত গ্রন্থ, দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি-তে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা, মানুষের সংগ্রাম ও জীবন-জীবিকার বিষয়টি অনুরূপ আলোকপাত করেছেন। বাংলা সাহিত্যের নদীনির্ভর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস, পদ্মার পলিদ্বীপ। এটি আবু ইসহাকের অমর সৃষ্টি। মোকারম হোসেনের মন্তব্যে- এই উপন্যাসে চিত্রিত জীবন সংগ্রামে নদীনালানির্ভর বাংলাদেশের এক উপেক্ষিত অথচ বৃহত্তর পরিধির আকাশ, বাতাস, ঘাস, জমি, মাছ, ফসল প্রভৃতি যেন কথা কয়ে গেছে একান্ত নির্লিপ্তভাবে। এ ছাড়া বিপ্রদাশ বড়ুয়ার সমুদ্রচর ও বিদ্রোহীরা, সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড উলেস্নখযোগ্য। প্রবন্ধ, ছড়া, কবিতা, ছোটগল্পসহ সাহিত্যে সব শাখায় নদীর নান্দনিক ছোঁয়া। কবি আল মাহমুদ তিতাস পাড়ের মানুষের জীবনের চিত্র কবিতায় এঁকেছেন, এঁকেছেন কর্ণফুলীর নৈসর্গিক রূপও। কবি দিলওয়ার লিখেছেন নদীনির্ভর হয়ে। মধুসূদন লিখেছেন কপোতাক্ষ নিয়ে। এ ছাড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনারতরী কাব্য নদীনির্ভর জীবনের দর্শনে লেখা। যেটি কবির সাহিত্য খ্যাতিকে আকাশচুম্বী হতে সহযোগিতা করেছে। অর্থাৎ, এ কথায় বলা যায় যে : টেমস, দানিয়ুব, রাইন, সিন ও নীল নদ মানুষের জীবন-জীবিকা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিনির্মাণে যে অগ্রণী ভূমিকা ধারণ করেছে, বাংলাদেশের নদীগুলো সেসবের সুযোগ্য ধারক।
মুহাম্মাদ রিয়াদ উদ্দিন
শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়