ঘামভেজা কাঁধে বেলচা, হাতে ইট ও বালু আবার কখনো সিমেন্টের বস্তা মাথায় এভাবেই শুরু হয়েছিল সুবর্ণচরের অসচ্ছল পরিবারের অদম্য তরুণ সাখায়েত উল্যাহ হৃদয় এর জীবনের সংগ্রাম। দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছে এখন সে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
শাখায়েত উল্যাহ হৃদয় উপজেলার চর আমান উল্যাহ ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের হতদরিদ্র কৃষক মো.মোস্তফা কামাল ও গৃহিণী তাছলিমা আক্তার দম্পতির বড় ছেলে। সে ২ বোন ৩ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। তার এক ভাই সাইফুল রাজমিস্ত্রির কাজ করে অপর এক ভাই একটি প্রাইভেট কোম্পানির কর্মচারী।
নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে দিন পার করা হৃদয় একদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এমনটা হয়ত কেউ ভাবেনি। শাখায়েত উল্যাহ হৃদয় একটি সাধারণ নাম কিন্তু যার জীবনের গল্প অসাধারণ। এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠা ছেলেটি কখনো নতুন জামা পায়নি ঈদে, পড়েনি চকচকে জুতা। স্কুলে যেত পুরোনো জামায় খালি পায়ে। অনেক সময় না খেয়ে। তবুও তার চোখে ছিল অদম্য স্বপ্ন ছোঁয়ার দীপ্ত বাসনা।
একান্ত আলাপনে হৃদয় তাঁর জীবনের সংগ্রামী স্মৃতি গুলো স্মরণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কান্না জড়িত কন্ঠে জানায়, কৃষক বাবার সামর্থ্য ছিল না তাই ৪র্থ শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় কখনো জুতা পায়ে স্কুলে যেতে পারেনি। ভালো পোশাক পড়তে পারিনি। বিরতিতে কলের পানি খেয়ে শান্তনা দিতাম নিজের ক্ষুদাকে। মাঝে মধ্যে বাবা ৫ টাকা দিতো, যেদিন ৫ টাকা পেতাম সেদিন আনন্দে বিমোহিত হতাম।এভাবে ২.৯২ পেয়ে পাশ করলাম পিএসসি। পিএসসি পাশ করার পর ভাবছি আমি পড়তে পারবো কিনা! বাবাও বলে দিয়েছে পড়াশোনা করানোর মতো আমার সামর্থ্য নেই।কাজে মনোযোগ দিতে বললেন তিনি। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি কোথাও কাজ করবো আর পড়াশোনা করবো। এখানেও বিপত্তি আমার ছোট মানুষ কাজ দিবে কে!
হৃদয়ের মাধ্যমিকের যাত্রা: বাবা কোন ভাবে মাধ্যমিকে ভর্তি করিয় দিলেন। আমি কোন ভাবে এক মিস্ত্রিকে কান্নাকাটি করে ১৭০ টাকা মজুরীতে হেল্পার হিসেবে কাজে লেগে গেলাম। সপ্তাহে কয়দিন কাজ করতাম আর কয়দিন ক্লাস করতাম। এভাবে করে স্কুলের বেতন আর নিজের আনুষাঙ্গিক খরচ চালাতাম। ষষ্ঠ শ্রেণীর বার্ষিক পরিক্ষার ফি ও বেতন বকেয়া মিলে ৬০০ টাকা বাবা দিতে পারেনি। কান্না করছিলাম তখন আমার ডিম বিক্রি করে আমাকে ২০০ টাকা দিয়েছে। আমি এ টাকা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে যাই তখন প্রধান শিক্ষক পরিক্ষার অনুমতি দেয়। বাকি টাকাও মা অনেক কষ্টে সংগ্রহ করে দিয়েছে। মায়ের এ টাকা না হলে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতেই হইতো পড়াশোনা শেষ হয়ে যেতো।
জেএসসি পরীক্ষার সময় বকেয়া ছিল ৩০০০ টাকা। মা ধার-দেনা করে দেয় পরে আমি কাজ করে মায়ের ধার করা টাকা পরিশোধ করি। ৬ষ্ঠ- ৮ষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত নির্মান শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে বহুবার আহত হয়েছি অনেক রক্ত ঝরেছে। তবুও পড়াশোনা ছাড়ার চিন্তা করিনি।
দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরিক্ষার পূর্বে, এসএসসি পরিক্ষার পরম পূরন কোচিং এর টাকার জন্য পাশের সন্দ্বীপ উপজেলা ২মাস নির্মান শ্রমিকের কাজ করে কিছু টাকা সঞ্চয় করি। এদিকে বাবা বারবার ছাপ দিচ্ছে পড়াশোনা বন্ধ করে পরিবারের কাজে মনোযোগী হতে। তখন খুবই আশাহত হতাম ও কষ্ট লাগতো আর ভাবতাম মনে হয় আমি বেশি দূর আগাতে পারবো না। তবে শত অবাব আর বাঁধার মাঝেও কেন যানি মনে হতো আমি পড়াশোনা করবো যেভাবেই হোক। পড়াশোনার করার নেশা আমাকে সকট কষ্ট ভুলিয়ে রাখতো।
হৃদয় জানায়,এভাবে এসএসসিও পাশ করালাম। আবার শুরু হলো এইচএসসি ভর্তি ও কলেজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করা নিয়মিত যুদ্ধ। বন্ধুরাও বলতো তোকে দিয়ে পড়াশোনা হবে না বাদ দে। কষ্ট করে বিদেশে চলে যা পড়াশোনা করে আর কি হবে! আমি তখন চুপ করে থাকতাম। একদিন এইচএসিও পাশ করলাম। তবে হতাশা আমাকে ঘিরে ধরলো পাশ কি হলো আমার ফলাফল তো ভালো না। জেএসসিতে ৩.০০ এসএসসিতে (ব্যবসা) ৩.৭৮ এইচএসসিতে (মানবিক) ৪.৩৩ জিপিএ পেয়ে তো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারনো না কিন্তু আমার স্বপ্ন হলো আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বই। এ চিন্তা আর স্বপ্ন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
এমন হতাশার মাঝে আমার এক সহপাঠী মিজানুর রহমান আমাকে নিয়ে গেলে এম্বিশন কোচিং সেন্টারের পরিচালক ও শিক্ষক ইয়াছিন আরাফাত আকাশ স্যারের কাছে। তিনি আমার সংগ্রামী জীবনের উচ্চ শিক্ষার আকাঙ্খায় বিমোহিত হয়ে আমাকে ভরসা দিলেন এবং তিনি সব দায়িত্ব নিয়ে আমাকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করালেন। মাস শেষে কোচিং এর কিছু টাকা দিয়েছি,পুরো টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। তখন আমি বললাম স্যার এ টাকা কিভাবে দিয়েছি জানেন? জানতে চাইলে হৃদয় বলে আমি নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে জোগাড় করেছি। আকাশ স্যার বিস্মিত হয়ে যায় আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছা দেখে। তিনি তখন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি করানোর জন্য বিনা টাকায় নিয়মিত কোচিং করান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে শুরু করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষায় প্রথমবার (গতবছর) অপেক্ষমাণ ফলাফলে থেকেও ভর্তি হওয়া সুযোগ পায়নি। অবশেষে এবার গুচ্ছতে ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উত্তীর্ণ হয়েছি। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে হৃদয় বলেন, আকাশ স্যার আমার জীবনের এক অনুপ্রেরণা ও পথপ্রদর্শক। তিনি আমার জীবনে নিভু নিভু বাতিতে আলোর জ্বালিয়েছে।
শাখায়েত উল্যাহ হৃদয়ের কোচিং শিক্ষক ইয়াছিন আরাফাত আকাশ জানান, দারিদ্রতার মতো কঠিন অন্ধকার হৃদয়কে আঁটকে রাখতে পারেনি। সে যেদিন আমার কাছে আসছিল সেদিন আমি তাকে বুঝতে পারিনি। তবে পরে তার ইচ্ছা শক্তি দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাকে একটু সহযোগিতা করতে পারলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে। তাই আমি তাকে আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। আজ সে একজন পাবলিকিয়ান হতে যাচ্ছে এবং তার স্বপ্ন পূরণ হলো।আমি আশা করি সে ভবিষ্যতে আরো ভালো করবে।
এ স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থী উচচ শিক্ষার আলো বুকে লালন করে সমাজের সকল বাঁকা চোখের পথ মাড়িয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে নিজের পথ চলাকে সাভাবিক রাখার সংগ্রাম করেছে নিরন্তর। বাস্তবতার কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তিনি আজ উচ্চশিক্ষার অন্যতম মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের পথে পা বাড়ালেন। এ যেন এক স্বপ্নের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
তার বাবা মোস্তফা কামাল কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, আমি আমার ছেলেকে পড়াশোনার করার জন্য সুযোগ করে দিতে পারেনি কারণ আমার নুন আনতে পান্তা পুরোই। সন্তানদের ক্ষুধার জালা মেটাতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছি সেখানে শিক্ষা আমার পরিবারের জন্য বিলাসিতা। আমি দরিদ্র হলেও একটি বারের জন্যেও হার মানেননি আমার ছেলে হৃদয়। দিনভর শ্রমের ক্লান্তি ভুলে রাত জেগে পড়তো বই। স্বপ্ন ছিল চোখে একদিন বড় কিছু করবে সে। নিজের পরিচয় বদলে দেবে একদিন। আমি ভাবতাম এটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু আমার ছেলের ইচ্ছ শক্তির কাছে আমি পরাজিত। সে নিজে কাজ করে SSC ও HSC পরীক্ষায় পাশ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় খুশিতে আমি আত্মহারা। আমার ছেলে আরো বড় হোক এপ্রত্যাশা করে তিনি ছেলের জন্য দোয়া চাইলেন সবার কাছে।
হৃদয়ের মা তাছলিমা আক্তার জানান,পরিবার অসচ্ছল হওয়ায় আমার ছেলে শিক্ষার সাভাবিক পরিবেশ ও পড়াশোনা খরচ বহন করতে পারিনি। এতে তার পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে তার নিজের চেষ্টা অন্যের কাজ করে যে আয় করতো আবার পরিবারেও কিছু টাকা সহযোগিতা করতো। আমার ছেলেকে আকাশ নামে এক কোচিং শিক্ষক সহযোগিতা করেছে সবসময়। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার ছেলে মানুষ হয়ে একদিন সমাজ ও দেশের সেবা করবে এই প্রত্যাশা করি সবসময়।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার খবর গ্রামে পৌঁছালে শুধু হৃদয়ের পরিবার নয়,গোটা এলাকাই যেন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এক নির্মাণ শ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয়ে? এমন গল্প কেবল সিনেমায় দেখা যায় অনেকে এমনটাই ভাবতেন। অথচ এই গল্প বাস্তব, এই গল্প সাখাওয়াত হৃদয়ের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষায় উত্তীর্ন হওয়া হৃদয় বলেন, “আমি জানি কষ্ট কী, আমি জানি স্বপ্ন কীভাবে গড়ে ওঠে। আমাদের মত হাজারো সংগ্রামী তরুণের জন্য কাজ করতে চাই একদিন।”ভর্তির টাকা না থাকায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কাজ করব। নির্মাণ সাইটে গিয়েই জীবনে প্রথম বার বুঝি কত কঠিন পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু তাতেও আনন্দ ছিল, কারণ জানতাম এই কষ্ট আমাকে একদিন মুক্তি দেবে।
তার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (চরআমান উল্যাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, শাখায়েত এর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি খবরে আমরা খুবই আনন্দিত। সে পড়াশোনার খরচ ও পরিবারের খরচ জোগাতে প্রায় বিদ্যালয়ে আসতে পারতো না। তাই তার মাধ্যমিকে পড়াশোনার বেশ ক্ষতি হয়েছে। নিজে শ্রমিকের কাজ করে খরচ জোগাড় করে নিজের স্বপ্ন পূরণ সোজা পথ নই। সে দারিদ্র্যকে পায়ে মাড়িয়ে শিক্ষাকে জয় করেছে।
এ বিষয়ে সৈকত সরকারি কলেজ এর সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ দিদার বলেন, হৃদয়ের এই গল্প নতুন প্রজন্মের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা। তার এই অর্জন প্রমাণ করে, ইটের ধুলোমাখা হাত দিয়েও লেখা যায় সাফল্যের গল্প। যেখানে ইচ্ছা, সেখানে পথ এই সত্যকে নিজের জীবনে রূপ দিয়েছে হৃদয়। হৃদয় এখন শুধু একজন শিক্ষার্থী নয়, একজন যোদ্ধা। তার এই সংগ্রাম আজ দেশের হাজারো পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর চোখে আশার আলো। তার গল্প প্রমাণ করে পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো দারিদ্র্য বাধা হতে পারে না।
যাযাদি/ এসএম