কাউকে বিনা বিচারে হত্যার সুযোগ নেই। কিন্তু যদি 'বন্দুকযুদ্ধ' বা 'ক্রসফায়ারের' নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটে তবে তার ভয়াবহতা কীরূপ- বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গত কারণেই এ সংক্রান্ত পরিস্থিতি আমলে নেওয়া এবং দেশে যেন কোনোভাবেই, কোনো নামেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনা না ঘটে, সেই লক্ষ্যে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। প্রসঙ্গত বলা দরকার, সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে 'বন্দুকযুদ্ধ' বা 'ক্রসফায়ারের' নামে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার এই হিসাব বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। জানা গেছে, তারা এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে।
আমরা বলতে চাই, ১৫ বছরে 'বন্দুকযুদ্ধ' বা 'ক্রসফায়ারের' নামে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন- এটি সহজ করে দেখার সুযোগ নেই। এর মধ্য দিয়ে যে ভয়ানক এবং শঙ্কাজনক পরিস্থিতি সামনে আসে তা আমলে নিতে হবে। একইসঙ্গে এ সংক্রান্ত বিষয়কে বিবেচনায় রেখে করণীয় নির্ধারণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে বলা দরকার, প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা গেছে, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেছেন, তারা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের এমন কিছু প্রস্তাব দিতে চান, যাতে আগামীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমরা মনে করি, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান যেটি বলেছেন, তা আশাব্যঞ্জক। কেননা, কোনোভাবেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অলিউলস্নাহ মোলস্না ২০১৬ সালের ১০ জুলাই পুলিশের 'ক্রসফায়ারে' নিহত হন। তার পরিবারের বক্তব্য, ওই দিন বিকালে অলিউলস্নাহকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী। পরদিন সকালে অলিউলস্নাহর মৃতু্যর খবর পায় পরিবার। পুলিশ তখন দাবি করেছিল, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৩টার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় টহলরত পুলিশ অলিউলস্নাহকে থামার সংকেত দেয়। তিনি না থেমে উল্টো পুলিশের দিকে বোমা ও গুলি ছোড়েন। তখন পুলিশের পাল্টা গুলিতে তার মৃতু্য হয়। পরে পুলিশের নথিতে এ ঘটনাকে 'বন্দুকযুদ্ধ' উলেস্নখ করে অলিউলস্নাহর পরিচয় লেখা হয় 'সন্ত্রাসী'।
প্রকাশিত খবরে উঠে এসেছে- মানুষ মারার প্রতিটি ঘটনার পর সরকারের তরফ থেকে প্রায় একই রকম গল্প বলা হতো। এসব যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, সেটা শেখ হাসিনা সরকার ও তার প্রশাসন আগাগোড়াই অস্বীকার করে গেছে বলেও খবরে উঠে এসেছে। তবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরের ক্রসফায়ারের তথ্য সংরক্ষণ করেছে। এতে দেখা যায়, এই সাত বছরেই 'ক্রসফায়ার' বা 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন ১ হাজার ২৯৩ জন। এছাড়া, দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। অন্যদিকে, এসবির হিসাবে সাত বছরে ক্রসফায়ারে নিহতের যে সংখ্যা বলা হয়েছে, আসকের হিসাবে সেই সংখ্যা আরও ১২০ জন বেশি। এটাও জানা যায়, ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্রসফায়ারের সাজানো বর্ণনা উলেস্নখ করে মামলা দেওয়া হয়, তাতে নিহত ব্যক্তির সহযোগী হিসেবে আরও অনেককে আসামি করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবারগুলো মামলা করার সাহস পেত না। আমরা মনে করি, যেসব তথ্য উঠে আসছে তা আমলে নিতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই।
সর্বোপরি বলতে চাই, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এমন বিষয়ও জানা যাচ্ছে- সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লক্ষ্যবস্ত ছিল আলোচিত অপরাধী বা দুর্র্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধ, প্রভাবশালীদের নির্দেশনা এবং প্রতিপক্ষকে দমনেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। সঙ্গত কারণেই সামগ্রিকভাবে এর ভয়াবহতা আমলে নিয়ে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধসহ কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত হোক এমনটি কাম্য।