মাদকাসক্তি আজকের সমাজে একটি গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকাসক্তি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির সমস্যা নয় বরং এটি আমাদের সমগ্র সমাজের জন্য একটি বড় হুমকি। বর্তমান সময়ে এই মাদকাসক্তি একটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে যেখানে মাদকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাদক একদিকে যেমন ব্যক্তি জীবনে অশান্তি এবং শারীরিক-মানসিক ক্ষতি ডেকে আনে, তেমনি সমাজের সার্বিক উন্নতি এবং শান্তির ক্ষেত্রেও বেশ বিপজ্জনক। মাদকাসক্তির কারণে অপরাধ, সহিংসতা, পারিবারিক অশান্তি এবং সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা বাড়তেই থাকে। যার ফলে, একটি সুস্থ এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমরা কি কখনো ভেবেছি আমাদের সমাজে কেন মাদকাসক্তির প্রভাব এত প্রখর হচ্ছে? কেন দিন দিন যুবসমাজ মাদক ব্যবহারের দিকে বেশি ঝুঁকছে? আমরা কি একটি মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারি না?
মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের মূল উদ্দেশ্য যে শুধু মাদক থেকে মুক্তি পাওয়া নয় বরং এটি এমন একটি সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা যেখানে প্রতিটি মানুষ সুস্থ, নিরাপদ ও সৃজনশীলভাবে জীবনযাপন করতে পারে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বা টেলিভিশনে দেখা যায়, পৌর শহরে কিংবা গ্রামগঞ্জে ওষুধের দোকানে গোপনভাবে নেশাজাতীয় দ্রব্য বা নেশা জাতীয় ট্যাবলেট অনেক কম দামে বিক্রি করছে। যার ফলে, এসব নেশা জাতীয় দ্রব্য অনেকেই কিনছে। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদকাসক্তি ও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। এর আওতায় মাদকদ্রব্যের উৎপাদন, বিক্রি, সরবরাহ এবং ব্যবহারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু তারপরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা আছে যারা টাকার বিনিময়ে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এ ধরনের ওষুধ বিক্রি করে। এমনকি ঘুমের ওষুধের সঙ্গে নানাধরনের দ্রব্য মিশিয়ে ঝাটকা, ফুটুস, ঝাঁকি নামে তরল ওষুধও বিক্রি করে থাকে।
দিনের পর দিন এই মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শহরের বস্তি এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু-কিশোর মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তির কারণ একেবারে যে একরৈখিক বিষয়টা কিন্তু তা নয়, বরং এটি বহুস্তরীয়। বিশেষ করে, তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো- কৌতূহল ও সামাজিক প্রভাব। আবার কখনো কখনো তারা বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা মানসিক চাপে মাদক সেবন করতে শুরু করে।
এরপর তাদের জীবনে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়তেই থাকে। মাদকাসক্তি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা- যার প্রভাব অনেক ভয়াবহ। মাদক সেবনের ফলে সরাসরি মানব দেহকে ক্ষতির দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের মাদক যেমন হেরোইন, কোকেন, মেথামফিটামিন, গাঁজা ইত্যাদি শরীরে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। যার ফলে, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ, এইচআইবি, হেপাটাইটিস, অগ্ন্যাশয় রোগ, ঘুমের সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক, লিভারের ক্ষতি এবং কিডনির সমস্যাসহ আরো অনেক ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। যা একটা মানুষকে দিন দিন মৃতু্যর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই মাদকাসক্তি শুধু যে শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরেই প্রভাব বিস্তার করে বিষয়টা তা নয় বরং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও এর প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে। দীর্ঘদিন মাদক সেবনের ফলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ যেমন- বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মানসিক অস্থিরতাসহ আরো অনেক রোগ দেখা দেয়। এছাড়াও মাদক সেবনের ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তি কমে যায়- যার ফলে, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার কিছু মাদক আছে যেমন- খঝউ বা মেথামফিটামিন- যা ব্যবহার করলে মানুষ বিভ্রান্তি, দৃষ্টিভ্রম বা হ্যালুসিনেশনেরও শিকার হয়ে থাকে। যার ফলে, বিপদজ্জনক পরিস্থিতির তৈরি হয়। এছাড়াও পারিবারিক অশান্তির অন্যতম কারণ হলো- পারিবারিক সহিংসতা বিশেষ করে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন। আবার অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, স্বামী-স্ত্রী বা পিতামাতার মধ্যে শারীরিক মারধর কিংবা মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। যার ফলে, পরিবারের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এছাড়া, এসব পারিবারিক অশান্তি শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তারা যখন নিজেদের পরিবারের মধ্যে অশান্তি দেখে, তখন তারা নিরাপত্তাহীনতা এবং অবহেলার অনুভূতি অনুভব করে- যা তাদের ভবিষ্যতের সম্পর্ক এবং আচরণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি এসব পারিবারিক অশান্তির কারণে ব্যক্তিগত এবং পরিবারের আর্থিক স্থিতিশীলতাও নষ্ট হয়ে যায়। যখন কোনো পরিবারে অশান্তি থাকে, তখন সেই পরিবারের সদস্যদের কর্মক্ষমতা কমে যায়। যার ফলে, তারা কাজেও মনোযোগ দিতে পারে না এবং পরিবারের আর্থিক সংকটও বাড়ে। এছাড়াও এসব পারিবারিক অশান্তির কারণে কোনো ব্যক্তিকে সমাজ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়। যদি কোনো ব্যক্তি পরিবারে সহিংসতা বা অশান্তির শিকার হয় তাহলে সে তার বন্ধুদের বা প্রতিবেশীদের কাছেও আত্মবিশ্বাস হারায়- যা সমাজে অসন্তুষ্টি এবং নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়। মাদক সেবন মানুষের নৈতিকতা ও বিবেককে দূূরে সরিয়ে দেয়- যার ফলে, তারা অনেক ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড যেমন- চুরি, ধর্ষণ, দুর্নীতি, খুন, লুটপাট, যৌন নিপীড়ন, শিশু নির্যাতন প্রভৃতি আরো অনেক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এছাড়াও মাদকাসক্ত ব্যক্তি কাজকর্মে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। ফলে তার উৎপাদনশীলতা কমে যায়। যার ফলে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতি হয় না। এমনকি এসব মাদক সেবনের কারণে চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, পুনর্বাসনের কার্যক্রমে সরকারের অধিক অর্থও ব্যয় হয়।
তাই মাদকাসক্তি প্রতিরোধের জন্য একটি সমন্বিত ও বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে- যাতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় স্তরে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়। তাই সর্বপ্রথম পরিবারে শিশুদের জন্য মাদক সেবনের বিপদ সম্পর্কে সবাইকে অবগত করতে হবে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে অভিভাবকদের সচেতনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তারা শিশু-কিশোরদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সঠিক পথে আনতে পারবে। এছাড়াও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মাদকবিরোধী মনোভাব তৈরি করতে হবে এবং সঠিক বন্ধু নির্বাচন করতে হবে যেন খারাপ সঙ্গ তাদের মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দিতে না পারে। এছাড়াও, মাদকদ্রব্য উৎপাদন, বিপণন, এবং সেবনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এমনকি প্রেসক্রিপশন ছাড়া মাদক বিক্রি বন্ধ করার জন্য নিয়মিত তদারকি চালাতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন- ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং রেডিও-টিভিতে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে। এছাড়াও, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকাসক্তির ভয়াবহ দিক সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতন করতে হবে। এমনকি মাদকাসক্তদের জন্য নিরাময় কেন্দ্র গঠন এবং পুনর্বাসনের কার্যক্রমগুলো শক্তিশালী করতে হবে।
তাই মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। মাদকমুক্ত সমাজ গঠন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার ফল। এটা শুধু মাদকসেবনের বিরুদ্ধে লড়াই না বরং এটি একটি সুস্থ, নিরাপদ এবং সুরক্ষিত সমাজ গঠনের মূল উপাদান। যার ফলে, একটি সুখী, নিরাপদ এবং স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করা যায়। তাই মাদক থেকে বিরত থাকি- সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ি।
সৈয়দা ফারিদা আখতার : কলাম লেখক