বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম পীঠভূমি ও উদাহরণ। এটি অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের বিষয়। পার্শ্ববর্তী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র দাবি করলেও মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমাদের দেশে এর প্রতিফলন ঘটেনি। এ দেশের মানুষের সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা বেশ লক্ষণীয়। মানুষের মধ্যে সচেতন মনোবৃত্তি আছে বলেই এ দেশের বুকে পার্শ্ববর্তী দেশের চরম সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড এবং ঘটনাবলির কোনো অশুভ প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর সঙ্গে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই মিলেমিশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে।
শুধু আজকাল নয়, সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্র্রীতির এ উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের নজিরটি এ দেশ-ই বহন করছে। খেতে- খামারে, কলে-কারখানায়, অফিস-আদালতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নানা সম্প্রদায় কাজ করেছে। একে অন্যের দুঃখে-আনন্দে শরিক হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে গভীর সংহতি ও ঐক্য জাতীয় ইতিহাসে গৌরবময় ঐতিহ্য ও ইতিহাস হয়ে আছে। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের তরুণদের গণ-অভু্যত্থান তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৭১ সালে এ দেশের হিন্দু- মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
কিন্তু সম্প্রতি বিগত পরাজিত ও পলাতক ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রেতাত্মারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিনষ্ট করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ইসকন নামের একটি বিতর্কিত ধর্মীয়গোষ্ঠীকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রত্যক্ষ ইন্ধন ও উপরোক্ত উগ্র ধর্মীয়গোষ্ঠীটির প্রত্যক্ষ হামলায় চট্টগ্রামে একজন তরুণ আইনজীবীকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিনষ্ট করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য একটি দাঙ্গা সৃষ্টি করে ২০২৪ বিপস্নব বা তরুণদের গণ-অভু্যত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং দেশে-বিদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারকে বিব্রত করা। কিন্তু সরকার ইতোমধ্যে উগ্র ধর্মীয়গোষ্ঠীটির একজন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে এবং আইনজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িতদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে- যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ কোন ক্রমেই বিনষ্ট না হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দাঙ্গার কথা বিশ্বের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে আছে। বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত, যেখানে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারগুলোকে টার্গেট করেছিল- যা ১৯৪৬ সালে বিহার দাঙ্গা নামে পরিচিত। মোগল আমলে ১৭৩০ সালে দোল খেলাকে কেন্দ্র করে হিন্দু- মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা লেগেছিল এবং লাখ লাখ লোকের রক্তক্ষয় হয়েছিল। ১৯২০ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। ১৯২২ থেকে ১৯২৭-এর মধ্যে ১৯২টি দাঙ্গার কথা জানা যায় এবং এতে অসংখ্য লোকের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই ভারতে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ১৯৪৬, ১৯৯০ সালেও ছোটখাটো দাঙ্গা লেগেছিল। ভারতের বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে যে দাঙ্গা হয় তা অবর্ণনীয়। হাজার হাজার লোক সে দাঙ্গায় জীবন দিয়েছে। এর পেছনে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের অদৃশ্য হাত ছিল। এসব দাঙ্গার রেশ আজও কাটেনি।
তবে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষিত হলেও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। তারা মুসলমান হিসাবে ধর্মভীরু হলেও ধর্মান্ধ নয়। কিন্তু বিগত সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিনষ্ট করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধর্মান্ধ হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত করার চেষ্টা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের বহু চেষ্টা করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং তরুণদের গণ-অভু্যত্থানে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তরুণরা এ ঐতিহাসিক ঘটনায় গৌরবান্বিত ও ইতিহাসের সাক্ষী। এক্ষেত্রে তারা দেশে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহান মন্ত্রে দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল। জাতীয়তাবোধের দৃঢ়বন্ধনে তারা আবদ্ধ।
পক্ষান্তরে ভারত আগাগোড়াই একটি সাম্প্রদায়িকতায় পরিপূর্ণ রাষ্ট্র বিশেষ করে বিজেপি সরকারের সময় এটি আরও বেগবান হয়েছে। ভারতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ভূঁইফোড় রাষ্ট্র ইসরাইলও আরকটি সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী রাষ্ট্র। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে ভারতের সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই, না মিডিয়া, না বুদ্ধিজীবী সমাজ, না উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়, না চিত্রজগতের অভিনেতা-অভিনেত্রী- কেউই সংখ্যালঘুদের পক্ষে নেই। সবাই একজোট হয়ে সংখ্যালঘু নির্মূল করার মিশনে নেমেছে যেন। অথচ তারাই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য মায়াকান্না করছে। বাংলাদেশে দু'একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও সরকারের পক্ষ থেকে ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বহু নজির আছে। অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এ রকম জটিল মুহূর্তে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির পাহাড়ার নজির আছে কিন্তু বিপরীতে ভারতে রাষ্ট্রীয় আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বছরের পর বছর সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের নির্যাতন করা হচ্ছে।
একটা দেশের অধিকাংশ মানুষ যে এতটা উগ্র সাম্প্রদায়িক মানসিকতার হতে পারে তা ভারতকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এমনকি ভারতের উচ্চশিক্ষিত সমাজের লোকরা পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক থেকে শুরু করে রেলস্টেশনের টোকাই পর্যন্ত আগাগোড়া প্রায় সব পেশার অধিকাংশ লোকই কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদী নীতির সমর্থক এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ প্রতিরোধ তো এরা করেই না বরং সমর্থন দেয়। এমনকি ভারতের চিত্রজগতের রথি-মহারথি এবং সুপারস্টাররা পর্যন্ত ব্যতিক্রম নয়। এরা উগ্র মোদি সরকারের ঘৃণার রাজনীতি প্রচার ও প্রসারে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। মোদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সিনেমা তৈরি এবং মুসলিমদের ধর্মকে অবমাননা করে নানারকম কন্টেন্ট তৈরির মাধ্যমে এরা সমাজে ঘৃণার বীজবপন করছে এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন বৃদ্ধির জন্য উসকানি প্রদান করছে।
যদিও সাম্প্রদায়িকতা এক দুরারোগ্য ব্যাধি, তবে এই ব্যাধির জীবাণু জাতির জীবনের গভীরে প্রোথিত। শুধু আইনশৃঙ্খলার কঠোরতার মধ্যেই এর সমাধান সূত্র নেই। তরুণ শিক্ষার্থীরাই হলো দেশের সবচেয়ে আদর্শপ্রবণ, ভাবপ্রবণ অংশ। ছাত্রসমাজই দেশের ভবিষ্যৎ, জাতির কান্ডারি। তাদের মধ্যে আছে অফুরান প্রাণশক্তি। পারস্পরিক শ্রদ্ধার মনোভাব, ভাবের আদান-প্রদান, সংগ্রাম ও আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালে এক গণ-অভু্যত্থানের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এক নতুন প্রজন্মের। এরই মধ্য দিয়ে ছাত্ররা নতুন করে অনুভব করছে মানবতার উদার মহিমা। ছাত্রাবস্থায়ই তাদের সাম্প্রদায়িকতার রাহু মুক্তির শপথ নিতে হবে। শিক্ষার নিবেদিত প্রাঙ্গণে তারা নতুন করে উপলব্ধি করবে সবার উপরে মানুষই সত্য। মানুষে মানুষে প্রীতিবন্ধনই হবে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিশ্বে ধর্মের নামে যে সহিংসতা এবং নৈরাজ্য তা শুধু ইসলাম নয়, বরং কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে কাউকে ধর্মের সুশীতল ছায়ার বেহেশতি বাতাসের স্বাদ যেমন উপভোগ করানো যায় না, তেমনি শান্তিও প্রতিষ্ঠা হয় না। নৈরাজ্যের মাধ্যমে কেবল বিশৃঙ্খলাই দেখা দিতে পারে, শান্তি নয়। আমি যে ধর্মেরই অনুসারী হই না কেন, সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। মতপ্রকাশের অর্থ এই নয়- যা খুশি তাই করা, প্রত্যেকটা জিনিসের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সম্প্রতি ধর্মীয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে যে ঘটনা ঘটেছে তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়, এ ধরনের উসকানি ও কৃষ্টতাপূর্ত কাজ যে কোন উপায়ে বন্ধ করতে হবে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ভারতে রাষ্ট্রীয় মদতে যেভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নানামুখী অত্যাচার নিপীড়ন চালানো হচ্ছে তা এক কথায় ভয়াবহ। তার চেয়েও ভয়ানক হলো- ভারত সরকারের এই উগ্রতার বিরুদ্ধে যাদের শক্ত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা সেই মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের পা চাটা গোলাম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দেখা যায় সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মীরা অন্তত নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকে, কিন্তু ভারত এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ভারতের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম চরম সাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট হাসিনার মতো উগ্র মোদি সরকারের কট্টর হিন্দুত্ববাদী নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক এরা। সংখ্যালঘুদের ওপর স্টিম রোলার চালানোর ক্ষেত্রে ভারতীয় মিডিয়া বরাবরই সরকারের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে- যা সাংবাদিকতা পেশার জন্য সত্যিই লজ্জার। অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পন্ড করার জন্য ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পরিকল্পনা ও নির্দেশে হিন্দু-মুসলমান রায়ট লাগিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এবারও পলাতক হাসিনার মদতে ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচার চালাচ্ছে। ভারতের গণমাধ্যম যেন বাংলাদেশবিরোধী পস্নাটফর্মে পরিণত হয়েছে এবং তাদের বক্তব্য বিবৃতি যেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার কূটকৌশলে ভারত সরকার বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। হাসিনার পরিকল্পনায় আবারও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা চলছে।
\হবাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ তার পাতানো ফাঁদে পা দেয়নি, সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে এবং বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় এ ধরনের যে কোনো অপচেষ্টা ভন্ডুল করতে বদ্ধপরিকর।
মো. জিলস্নুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক