দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক খাত ধ্বংস করা হয়েছে। সাবেক আমলা ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব পাওয়ার পর ব্যাংক খাতের অবস্থা ক্রমেই ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক এই দুই গভর্নর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে পুরো ব্যাংক খাত বলতে গেলে মাফিয়া চক্রের হাতে চলে গিয়েছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নররা যেসব নীতিমালা গ্রহণ করেছেন সেগুলোর অধিকাংশই ব্যাংকিং আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অগ্রহণযোগ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেসব ভালো চর্চাগুলো ছিল সেগুলোকে পাশকাটিয়ে অথবা নতুন নিয়ম তৈরি করে প্রতিনিয়ত বিশেষগোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার আয়োজন করেছেন তারা। অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রসারে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে, বিশেষগোষ্ঠীর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ চলে গেছে। হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পলায়নের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও দেশের আর্থিক খাতে এক লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
২০১৪ সালে দেশে একতরফা নির্বাচনের পর ব্যাংক খাতে একের পর এক ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন বা এক টাকাও শোধ না করে ঋণ নিয়মিত দেখানোর মহাসুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ২০১৭ সালে ফজলে কবির গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর তার মধ্যস্থতায় ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক লোপাটকারীদের হাতে তুলে দেওয়া, হোটেলে বসে সিআরআর কমানোর সিদ্ধান্ত, আমানতে ৬ শতাংশ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা নির্ধারণ, নিয়ম ভেঙে ব্যাংকের সিএসআর তহবিলের বড় অংশই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেওয়াসহ নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিকভাবে লাইসেন্স পাওয়া এসব তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের অধিকাংশ ব্যাংকই বর্তমানে মৃতপ্রায় অবস্থায় আছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, অন্তত ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। মূলত, এসব ব্যাংকের চলনশক্তি নেই, জনগণের করের টাকায় বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা এবং উপযুক্তমাত্রায় শাস্তি নির্ধারণ না করায় সরকার কর্তৃক খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে ঋণখেলাপিদের জন্য প্রদত্ত সুবিধাদি ও প্রণোদনাসমূহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য প্রযোজ্য হওয়ায় ঢালাওভাবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা ভোগ করে থাকে। একক ব্যক্তি বা গ্রম্নপ একটি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে পারবে, তা একক বৃহত্তম ঋণসীমা নীতিমালায় নির্ধারিত হলেও, সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে ব্যক্তি ও গ্রম্নপের সর্বোচ্চ ঋণসীমা নির্ধারণ উলেস্নখ না থাকার সুযোগে ঋণ গ্রহীতারা বিশেষত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা বিভিন্ন কৌশল ও যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, থেকে ঋণ বের করে নিয়েছে- যার উলেস্নখযোগ্য অংশ পরবর্তী সময়ে খেলাপি হয়ে পড়ছে। গণমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যায়, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা পরস্পরকে দিয়েছেন প্রচুর পরিমাণে ঋণ। কিছু ব্যাংক আরও এক ধাপ এগিয়ে এসব ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের আত্মীয়দের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এমনকি বাসার কাজের বুয়া থেকে শুরু করে নানা নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছে।
আইনিভাবেও ব্যবসায়ী ও ব্যাংক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের প্রভাবে ব্যবসায়ীদের অনুকূলে আইন পরিবর্তন এবং নানাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন নীতি ও বিধি-বিধান প্রণয়নে হস্তক্ষেপ করা হয়। যেমন : ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১-এর ধারা সংশোধনের মাধ্যমে একই পরিবার থেকে দুই জনের পরিবর্তে চারজন পর্যন্ত পরিচালক রাখার বিধান করা হয় এবং পরিচালকের মেয়াদ পরপর দুইবারে সর্বোচ্চ ছয় বছরের পরিবর্তে পরপর তিনবারে সর্বোচ্চ নয় বছর থাকার বিধান কিছু পরিবারের হাতে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে দেয়। রাজনৈতিক প্রভাবে চেয়ারম্যান বা পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয় এবং অনুগত প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেওয়া হয়।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতার সবচেয়ে আশঙ্কাজনক নির্দেশক হলো, গত ১৫ বছরে উলেস্নখযোগ্যভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত খেলাপি ঋণ (এনপিএল)। ২০০৯ সালে ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা- যা বেড়ে মার্চ ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সংখ্যাটি আসলে আরও অনেক বেশি। খেলাপি ঋণের হিসাব নিয়েও চলে এক ধরনের লুকোচুরি। খেলাপি ঋণের বৃহৎ অংশই কৌশলে কারপেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণকৃত মোট প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা- যা মোট ঋণের প্রায় ৩২ শতাংশ। এই ঋণের মধ্যে আছে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল করা ঋণ ও রাইট-অব ঋণ। প্রকৃতপক্ষে, দুর্দশাগ্রস্ত পুরো অর্থই ঋণ খেলাপি। অর্থনীতিবিদদের মতে এ ধরনের ঋণ এটাই প্রমাণ করে, কীভাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থা লুটপাটের উন্মুক্ত মাঠে পরিণত হয়েছে এবং প্রভাবশালীরা নির্বিঘ্নে ব্যাংক থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব ঋণের অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়েছে- যা কখনোই আদায় হওয়ায় সম্ভাবনা নেই।
ইতোপূর্বে বহুবার ব্যাংক সংস্কারের কথা শোনা গেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংক খাত সংস্কারের পরিবর্তে উল্টো ব্যাংক লুটের মহড়া দেখা গেছে। এতে দেশের পুরো অর্থনীতি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েছে। অবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে ৬ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক- যা অত্যন্ত ইতিবাচক সংবাদ। এই টাস্কফোর্স আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন যেমন ব্যাংক কোম্পানি আইন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ইত্যাদির সংস্কার এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, ব্যাংক অধিগ্রহণ ও একীভূতশরণ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, সংস্কার ও যুগোপযোগীকরণের প্রস্তাব দেবে এবং ব্যাংকিং খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশের পদক্ষেপ নেবে। এ টাস্কফোর্সের কোন কোন খাতে অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তার একটা প্রস্তাবনা পেশ করছি। (১) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। একইসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে ব্যাংকিং বিভাগ চালু আছে, তা স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করা দরকার। এর ফলে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হবে। মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করবে একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক। (২) সৎ, নিষ্ঠাবান, দক্ষ ব্যাংক ও আর্থিক বিষয়ে অভিজ্ঞ গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর না হলে দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রত্যাশা করা যায় না। তাই বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এবং অনুসন্ধান কমিটি গঠনের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। (৩) সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যাংকারদের মাধ্যমেই দুর্নীতির বীজবপন হয়। এক সময় বেসরকারি ব্যাংকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী কর্মী নিয়োগ করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব ও অবৈধ অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে বিশেষ অঞ্চলকে বেছে নিয়ে কর্মী নিয়োগ শুরু হওয়ার ফলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অব্যবস্থাপনা বহুমাত্রিক আকার ধারণ করে। অনেক ব্যাংক নিয়োগ প্রক্রিয়ার নূ্যনতম নীতিমালা অনুসরণ না করেই হাজার হাজার অযোগ্য কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। ফলে বর্তমানে অনেক বেসরকারি ব্যাংকে সৎ, দক্ষ ও পেশাদার কর্মীর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাই কর্মী নিয়োগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও সরকারি ব্যাংকের মতো 'ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটি (বিআরসি)'-এর আদলে 'বেসরকারি ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটি (বিবিআরসি)' অথবা এ ধরনের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত। এটি সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্ব্বাবধানে অথবা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সমন্বয়েও গঠিত হতে পারে- যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। (৪) আগামী ১৫ বছরের মধ্যে নতুন করে আর কোনো ব্যাংকের অনুমোদন না দেওয়া। (৫) এক ব্যক্তি, পরিবার বা গ্রম্নপের হাতে একাধিক ব্যাংকের মালিকানা প্রদান শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে। (৬) গ্রম্নপ নয়, একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় নিয়ে একক ঋণ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। (৭) গ্রম্নপের সর্বোচ্চ ঋণসীমা উলেস্নখ থাকতে হবে। (৮) একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ ৩ বছর মেয়াদে একজন পরিচালক এবং সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে থাকতে পারবে। (৯) ঋণখেলাপি এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা যুগপোযোগী করতে হবে। (১০) অর্থ পাচারকারীদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত, তাদের রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা বাতিল এবং সর্বোচ্চ শান্তি মৃতু্যদন্ড আইন কার্যকর করতে হবে। (১১) সিআইবির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে থাকতে হবে। (১২) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক টিমকে শক্তিশালী ও আধুনিকায়ন করতে হবে। (১৩) এক ব্যাংকের পরিচালক যাতে অন্য ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে ঋণ নিতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। (১৪) বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আমদানিতব্য মালের মূল্য যাচাইকরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। (১৫) একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ঋণ নিতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের ব্যবস্থা থাকা উচিত। (১৬) অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিপদগ্রস্ত ব্যাংকে সহায়তা করা উচিত নয়। একটা সময় অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করা উচিত। (১৭) ঋণখেলাপিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কালো তালিকাভুক্ত করতে এবং তাদের পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের নাম ঠিকানা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। (১৮) খেলাপি ঋণ বেশি হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঋণ থেকে। ব্যাক টু ব্যাক (বিবি) এলসি রপ্তানিতে ব্যবহার না করে অনৈতিক খাতে ব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। অভিযোগ আছে, এ ধরনের বাণিজ্যের ৭০-৮০ শতাংশ জালিয়াতি ও অর্থ পাচার হয়। কাজেই বিবিএলসির শতভাগ মালামাল যাতে সংশ্লিষ্ট এলসি/চুক্তির বিপরীতে রপ্তানি সম্পন্ন হয় সে ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রয়োজনে এজেন্ট নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে মালামাল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। (১৯) ব্যাংক খাতে অন্যতম সমস্যার মূলে রয়েছে পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণের উপস্থিতি। এ খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং ট্রাইবু্যনাল গঠন করে মামলা দ্রম্নত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। (২০) অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকগুলোর লোপাটের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। এসব লোপাটকারী এবং এদের সহযোগীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে কঠোর বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (২১) সব গ্রাহকের একটি ইউনিক আইডি (এনআইডিও হতে পারে)- যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ওই আইডির বিপরীতে সব ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে। একজন গ্রাহকের একটি ব্যাংকে সমজাতীয় একাধিক হিসাব থাকতে পারবে না। তাহলে জাল-জালিয়াতি প্রতিরোধ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। (২২) ইদানীং অসাধু মালিকপক্ষের চাপে অনেক ব্যাংকের সফটওয়্যার ম্যানিপুলেশন করার মাধ্যমে কৌশলে সুদ হার হ্রাস বা সুদ নির্ণয় না করা, খেলাপি ঋণ/বিনিয়োগকে নিয়মিত দেখানো এমনকি অনেক ক্ষেত্রে লেনদেন মুছে ফেলার অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্ব্বাবধানে সব ইসলামী ব্যাংকের একটি ইউনিক সফটওয়্যার থাকা উচিত, যার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকবে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্নীতিগ্রস্ত হলে এর সুবিধা কতটুকু পাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। (২৩) প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের কোনো মালিক নেই তবে শেয়াহোল্ডার আছে। তাই ব্যাংকিং আইনকানুন, গাইড লাইন্স, সার্কুলারসহ সব ধরনের ডকুমেন্টে ব্যাংকের 'মালিক' শব্দটি স্থায়ীভাবে বাদ দিতে হবে।
বর্তমানে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের যে অবস্থা তা যে কোনো মানসম্পন্ন একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে। ব্যাংক খাতের বহুবিধ অনিয়ম দুর্নীতির কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও বড় বড় রাঘব বোয়াল এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছে। অনেকের মনে আশঙ্কার দানা বাঁধছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ক্রমেই ঢিলেঢালা হচ্ছে না তো?
সংস্কার কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হতে হবে ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও দূরীকরণের মাধ্যমে এ খাতকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। সংস্কারের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও লোপাটকারীদের দ্রম্নত শাস্তির ব্যবস্থা করাই সবার প্রত্যাশা।
এম এ মাসুম :ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক