শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে

ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য পস্নাটিলেট কাউন্ট মনিটরিং, আইসিইউ সেবা এবং ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালে এসব সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।
ইমরান ফয়সাল
  ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে

ডেঙ্গু হলো একটি ভাইরাসজনিত রোগ- যা এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস এলবোপিকটাস নামক দুই প্রকার মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। সাধারণত বর্ষাকালে এবং এর পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির উচ্চ জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেশি ও অস্থিসন্ধি ব্যথা এবং ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক হয়ে রক্তক্ষরণ ও অঙ্গহানির কারণও হতে পারে।

বর্তমান সময়ে মশার উপদ্রব দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সময়ে আমরা দেখতে পাই, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায়, আবাসিক এলাকায় ও ভবনগুলোর আশপাশে ময়লা-আবর্জনা থাকায় মশার উৎপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারই ফলস্বরূপ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা বড় সমস্যায় পড়েছে। বিশেষ করে শীতের শুরুতে মশার প্রাদুর্ভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। মশার কামড়ে ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া ও চিকনগুনিয়ার মতো রোগ হয়, এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বেড়ে যায়। অত্র ক্যাম্পাসগুলোতে মশা প্রতিরোধে বিভিন্ন সাইড সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এ সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট নয়। এ সমস্যা নির্মূলের জন্য কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রম্নত মশকদমন কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং ক্যাম্পাস ও হলের নোংরা জায়গায়গুলো পরিষ্কার রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, বাড়ির চারপাশে জমে থাকা পানি ডেঙ্গু মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান তৈরি করে। তাই ঘরের ভেতরে ও বাইরে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ফুলের টব, ভাঙা পাত্র এবং ব্যবহৃত টায়ার ইত্যাদি স্থানে কেরোসিন বা কীটনাশক ব্যবহার করে মশার লার্ভা ধ্বংস করতে হবে। তৃতীয়ত, ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় প্রতিনিধি সঙ্গে মিলে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। সেইসঙ্গে স্কুল, কলেজ ও কর্মক্ষেত্রে ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সেমিনার বা কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। চতুর্থত, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা এবং দিনে মশার কামড় থেকে সুরক্ষা পেতে মশা করতে হবে। শিশুদের ডেঙ্গু থেকে রক্ষা করতে তাদের সব সময় সমস্ত হাত ও পা ঢাকা পোশাক পরানোর চেষ্টা করতে হবে।

ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রম্নত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সাধারণত পর্যাপ্ত বিশ্রাম, তরল পানীয় এবং প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই নিজের ইচ্ছায় ওষুধ সেবন করা যাবে না। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করা সম্ভব। সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে এবং অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।

চলতি বছরের এগারো মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত নব্বই হাজার ছাড়িয়েছে। মারা গেছেন অন্তত চারশ' আটচলিস্নশ জন। শীত মৌসুম শুরু হলেও কমছে না ভাইরাসটির প্রকোপ। এরই মধ্যে জিকা ও চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিও মিলছে। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নির্মূলে টিকা প্রয়োগে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. জাফরউলস্নাহ চৌধুরী বলেন, চলতি বছর শীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। এবার ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার শক সিনড্রোমে মৃতুু্য বেশি হয়েছে। আক্রান্ত বেশি হয়েছে। ডেঙ্গু দুই ধরনের। ডেঙ্গুর প্রকোপ বছরজুড়ে থাকায়, ভাইরাসটির প্রতিরোধে টিকা প্রয়োগে জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গুর যে দু'টি টিকা প্রয়োগ হচ্ছে, তার একটি ফ্রান্সের বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুত কারক প্রতিষ্ঠান সানোফির তৈরি ডেঙ্গুভ্যাক্সিয়া। অন্যটি জাপানের তাকেদা ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কেউডেঙ্গা। এসব টিকা বাজারজাত হচ্ছে এবং অন্তত সাতাশটি দেশ প্রয়োগ করেছে। নবজাতক শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, এ বছর আট হাজারের বেশি শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এটি খুবই উদ্বেগজনক। শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে টিকার প্রতি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্তমানে ডেঙ্গুর সুচিকিৎসা প্রদানে অনেক সংকট লক্ষ্য করা যায়- যা আদৌ কাম্য নয়। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। অনেক হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা নেই। ফলে, রোগীদের বারান্দায় বা মেঝেতে থাকতে হচ্ছে।

ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য পস্নাটিলেট কাউন্ট মনিটরিং, আইসিইউ সেবা এবং ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালে এসব সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।

ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। কিন্তু অনেক চিকিৎসক ও নার্স ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষিত নন- যা রোগীর জন্য ঝুঁকি বাড়ায়। পস্নাজমা, ডেক্সট্রোজ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রতুল। এর ফলে, রোগীদের চিকিৎসা বিলম্বিত হচ্ছে।

সরকারকে আরও শয্যা সংযোজন, আইসিইউ ইউনিট স্থাপন এবং জরুরি সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন জরুরি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা, যেমন জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখা এবং মশারি ব্যবহার করা, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মশা নিধনে স্থানীয় সরকার ও এনজিওদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি। বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পরিষ্কার পানি ফেলে দিতে হবে, কারণ এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। ফুলের টব, ভাঙা পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার এবং কনটেইনারে পানি জমে থাকতে না দেওয়াই শ্রেয়, বাড়ির ড্রেন ও জলাধার পরিষ্কার রাখতে হবে। লম্বা হাতা ও পায়ের গোঁড়ালি পর্যন্ত ঢাকনা থাকে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। বিশেষ করে ভোর এবং সন্ধ্যার সময়, যখন এডিস মশা বেশি সক্রিয় থাকে, তখন সুরক্ষিত পোশাক পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা তাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার করতে হবে। বাড়িতে মশার কয়েল, বৈদু্যতিক মশা তাড়ানোর যন্ত্র বা নেটিং ব্যবহার করতে হবে। প্রতিদিন বাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন। কারণ এডিস মশা সাধারণত অন্ধকার এবং ঠান্ডা জায়গায় লুকিয়ে থাকে। ডেঙ্গুর উপসর্গ সম্পর্কে নিজেকে প্রথমে জানতে হবে এবং তা অন্যদের জানাইতে হবে। বমি, জ্বর, শরীর ব্যথা এবং ত্বকে লাল দাগ দেখা দিলে দ্রম্নত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মশা নিধনের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে ফগিং কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে। নিজ এলাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সচেতন নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখতে হবে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার জন্য ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উভয় স্তরেই সতর্কতা প্রয়োজন। মশার প্রজনন রোধ এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়াই এই রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকার মূল চাবিকাঠি।

\হ

ইমরান ফয়সাল :নবীন কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে