শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

প্রসঙ্গ এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানা ধরনের সংস্কার কমিটি তৈরি করেছেন দুর্নীতি ও বৈষম্য নিরসনের জন্য। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত, বিশেষ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিরসনে আলাদা একটি সংস্কার কমিটি করার। দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আখড়ায়। এই আখড়াটা সুশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। যদিও বর্তমানে এনটিসিআর-এর মাধ্যমে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
প্রসঙ্গ এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান

সারাদেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২২ হাজার ১৭৪টি। গত সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে নতুন করে এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল ৬ হাজার ৮০৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। এ প্রতিষ্ঠানে মূল বেতন ও কিছু ভাতা সরকার থেকে পেয়ে থাকে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম।

বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রদানে ক্ষেত্রে প্রায় ৮৫ শতাংশ কভারেজ দিচ্ছি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের একটা বড় অংশ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এই অংশটার জন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সারাদেশে সমালোচিত। হাসিনার সরকারের পতনের পর এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে আবার কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে এবং কিছুসংখ্যক জনরোষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষ করে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ গঠন করার ক্ষেত্রে রয়েছে একটু জটিলতা। গত সরকারের আমলে এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে সরকারদলীয় ব্যক্তিরা। ফলে, প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ-বিয়োগ কার্যাদিতে রয়েছে নানা ত্রম্নটি ও দুর্নীতি। আওয়ামী সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপটে হয়েছে নজিরবিহীন দুর্নীতি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার ধীতপুর গ্রামে সায়রা সাফায়েত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. আমানউলস্নাহ। এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তার ভাতিজা, আরেক ভাতিজা অফিস সহকারীসহ বেশ কয়েকটি পদে পরিবারের লোকজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। ডা. আমানুলস্নাহর পরিবারের যারা উলিস্নখিত পদে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অনেকেই উলিস্নখিত চাকরির করার মতো যোগ্য নয়। এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসমূহের গর্ভনিং বডির সভাপতি হয়েছেন যারা তারা ছিল সরকার দলীয় কর্মী। এমন সবকিছু লোক যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নূ্যনতম যোগ্যতা টুকও নেই, এরকম অযোগ্য ব্যক্তিদের সভাপতি বানিয়েছেন এমপিরা। আর এমপি ও সভাপতির যোগসাজশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সরকারদলীয় কিছু তাবেদার। যারা শিক্ষার সংজ্ঞাটুকুও বলতে পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। এই তাবেদাররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ অন্যান্য কিছু শিক্ষক সারাক্ষণ সভাপতির স্তুতি গেয়ে বেড়াতেন। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ির উপজেলায় এমন কিছু চিত্র দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। সভাপতিকে কিছুসংখ্যক শিক্ষক সৃষ্টি কর্তার পরের পূজনীয় হিসেবে তোষামোদ করতেন। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের চেয়ে সভাপতির পেছনের ঘুরতে পছন্দ করতেন বেশি। তাই পড়াশোনা শিকেয় উঠেছিল। তখন ঠিকমতো পড়াশোনা হতো না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। হাসিনা সরকারের পতনের পর গোদাগাড়ির উপজেলার মাটিকাটা কলেজের অধ্যক্ষ জনরোষ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার দাযিত্বে আছেন একজন নারী শিক্ষক। তবে এই কলেজে একটি একাডেমিক প্রধানের পদ রয়েছে। যিনি গত সরকারের আমলে এমপি সাহেবের বদন্যতায় এই পদটি লাভ করেন। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শুধু নামে মাত্র, একাডেমিক প্রধানই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি এখন অবাধে চাঁদাবাজিসহ নানা দুর্নীতি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন; এই তথ্যটি বিভিন্ন মহল থেকে তা জানা যায়। এমপিওভুক্ত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। কদম শহর এলাকার একটি হাইস্কুলের একজন শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে এমপি ও তার প্রেরিত স্কুল কমিটির সভাপতিকে ১৬ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে পদটি লাভ করেন। এত টাকা ঘুষ দিয়ে প্রধান শিক্ষক কেন হলেন, এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা গাছে, প্রতিষ্ঠান প্রধান বেতনের বাইরে অন্য উপায়ে টাকা উপার্জন করতে পারেন। যেমন স্কুল ফান্ড তছরুপ, উপবৃত্তি টাকা নয় ছয়, ছাত্র বেতনের টাকার যথাযথ হিসাব না দেয়া, (এসব পারেন তিনি; কারণ, তিনি সভাপতি তার কাছের মানুষ) তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগসহ নানা উপায়ে তিনি অর্থ উপার্জন করতে পারেন একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান। তাই লাখ লাখ টাকা দিয়ে এই পদে নিয়োগ নেন প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষকরা। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজের সভাপতি হয়েছেন অনেকেই স্থানীয় এমপিকে সন্তুষ্ট করে (ঘুষ দিয়ে)। ভালুকা উপজেলার বেশ কয়েকটি হাইস্কুলে মোটা টাকার বিনিময়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। এই সুবিধাভোগী প্রধান শিক্ষকরা কিন্তু আওয়ামী সরকারের পতনের পরও বহাল তবিয়তে আছেন। অনেকেই বলে থাকেন, এরা ম্যানেজ করার সিস্টেমটা জানেন, তাই তারা বহাল তবিয়তে আছেন।

একাডেমিক প্রধান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর চাঁদা নিয়েছেন ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে ছাত্র পাঠিয়ে দেবেন বলে হুমকি দিতেন। ছাত্রদের ভয়ে তিনি চাঁদা দিতে বাধ্য করতেন মানুষকে। তিনি এক ব্যবসায়ীর কাছ প্রতিটি ১৩ টাকার দামের ইট কিনেছেন ৯ টাকা করে। প্রায় তিন হাজার ইট এভাবে নিয়েছেন ছাত্রদের দিয়ে ভয় দেখিয়ে। যতদূর জানা গেছে, সরকার পাল্টায় কিন্তু তিনি প্রতিটি সরকারের পক্ষালম্বন করেন। সারাদেশে এ রকম ধুরন্ধর ব্যক্তি রয়েছেন অনেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরা নিজ এলাকায় চাকরি করে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করেন। এই ধরনের ব্যক্তি শিক্ষক পেশায় নিয়োজিত থাকায় দেশের শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে না।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানা ধরনের সংস্কার কমিটি তৈরি করেছেন দুর্নীতি ও বৈষম্য নিরসনের জন্য। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত, বিশেষ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিরসনে আলাদা একটি সংস্কার কমিটি করার। দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আখড়ায়। এই আখড়াটা সুশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। যদিও বর্তমানে এনটিসিআর-এর মাধ্যমে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

\হতবে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সহকারী প্রধান ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দেন পরিচালনা কমিটি। এখানে যে ঘুষ বাণিজ্য চলে তা কল্পনা করা যায় না। এখানে অশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে যে পরিমাণে ঘুষ দেয় তা শুনলে চোখ চড়ক গাছ হয়ে যায়। কেন এত বেশি টাকা ঘুষ দিয়ে এখানে নিয়োগ পেতে চায়? তা জানতে গেলে চোখ কপালে উঠে যাবে। তারা জানায়, এলাকায় অর্থ্যাৎ নিজ বাড়িতে থেকে চাকরি করা যায়, প্রতিদিন না গেলেও চলে; তাছাড়া, দৈনিক ডিউটি মাত্র তিন চার ঘণ্টা, এই দৈনিক ডিউটি করে অন্য ব্যবসা করা যায়। মাটিকাটা কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কলেজের সঙ্গে একটি মুদির দোকান চালাচ্ছে পাশাপাশি কলেজের কাজও করছেন। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার এমপিওভুক্ত কলেজের শিক্ষক রীতিমতো ঠিকাদারি করছেন সারা জেলাজুড়ে।

সরকারের উচিত সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই দুর্নীতি নিরসনে পদক্ষেপ নেয়া।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে