যেসব পুকুর স্থানীয় মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে, সেসব পুকুর যদি দখল দূষণের শিকার হয় তবে পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ পুকুরের পানি দূষিত। বিশেষ করে পাড় দখল ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুকুরগুলোর অবস্থা এখন সংকটাপন্ন। মালিকানা নিয়ে সমস্যা থাকায় কিছু পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও জটিলতা রয়েছে। অথচ স্মর্তব্য যে, এসব পুকুর মোগল ও ব্রিটিশ আমল থেকে স্থানীয় মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে। এমনকি বিভিন্ন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় এসব পুকুরের পানি আগুন নেভাতে ভূমিকা রেখেছে। পুকুরগুলো এখনো স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে, সার্বিকভাবে যে তথ্য সামনে আসছে এগুলো আমলে নিতে হবে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়।
বলা দরকার, ঢাকা শহরের আটটি পুকুর নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা গবেষণা করেছে, আর দখল দূষণ সংক্রান্ত তথ্য উঠে এসেছে তাদের গবেষণায়। গবেষণায় পাওয়া তথ্য নিয়ে বুধবার সকালে বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাকক্ষে 'স্থানীয় পর্যায়ে শহুরে পুকুর ব্যবস্থাপনা ও অংশীজনদের ভূমিকা' শীর্ষক এক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। জানা গেছে, বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের লেভেল-৪, টার্ম-২ এর শিক্ষার্থীরা আটটি গ্রম্নপে ভাগ হয়ে ঢাকার আটটি পুকুরে এই গবেষণা চালান। পুকুরগুলো হলো- এলেনবাড়ী পুকুর, লালমাটিয়া বিবি মসজিদ পুকুর, বংশাল পুকুর, টিকাটুলী এনটিআরএস পুকুর, সিক্কাটুলী পুকুর, আলুবাজার পুকুর, গোল তালাব পুকুর এবং কালীবাড়ি পুকুর।
আমলে নেওয়া দরকার, শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে- আলুবাজার পুকুরে বর্জ্যদূষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে। বংশাল পুকুরে পাড় দখল, গাছপালা না থাকাসহ স্থানীয় লোকজনও স্বেচ্ছায় পুকুর রক্ষার কমিটিতে থাকতে চান না। গোল তালাব পুকুরের পাড়ে অবৈধ পার্কিংসহ সব সময় মানুষের ভিড় লেগে থাকে। এ ছাড়া সিক্কাটুলী পুকুরে বর্জ্যদূষণের সঙ্গে রয়েছে মালিকানা সমস্যা। টিকাটুলী পুকুরে পানিদূষণের পাশাপাশি চলে নানা অসামাজিক কার্যকলাপ এমন তথ্যও উঠে এসেছে। এলেনবাড়ী পুকুরের পানিও অপরিষ্কার। কালীবাড়ি পুকুরের পাড় ভেঙে যাচ্ছে, পানিও দূষিত। আর লালমাটিয়া বিবির মসজিদ পুকুরে দূষিত পানির সঙ্গে রয়েছে মশা ও কীটপতঙ্গ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আমলে নেওয়া দরকার, গবেষণার সুপারিশে শিক্ষার্থীরা স্থানীয় জনগণকে পুকুর ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দিয়েছেন। এমনকি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিতেরও প্রস্তাব দেন। এ ছাড়া সুপারিশে পুকুরপাড়ে মানুষের বসার কিংবা হাঁটার ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তা নিশ্চিতে পাড়ে আলোর ব্যবস্থা করা, বর্জ্য ফেলা বন্ধ, প্রয়োজনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা এবং পুকুরকেন্দ্রিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মসূচি আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের এসব সুপারিশ আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিভিন্ন সময়ে নদী খাল দূষণ সংক্রান্ত খবর উঠে এসেছে- যা উদ্বেগের। এছাড়া, বায়ুদূষণসহ রাজধানীতে নানা ধরনের সংকট আছে। আবার যখন জানা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ পুকুরের পানি দূষিত। বিশেষ করে পাড় দখল ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুকুরগুলোর অবস্থা এখন সংকটাপন্ন; তখন সার্বিক পরিস্থিতি এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। সুপারিশ আমলে নেওয়া এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে করণীয় নির্ধারণ ও তার যথায়থ বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।
সর্বোপরি বলতে চাই, সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের দেওয়া সুপারিশের বাইরে কর্মশালায় অংশ নেওয়া অংশীজনদের আলোচনায় আরও কিছু প্রস্তাব উঠে আসে। যেখানে পুকুরগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা, শোভাবর্ধন, পয়োবর্জ্যের নালা এবং অস্থায়ী বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস) অপসারণের বিষয়গুলো উঠে আসে। পাশাপাশি পুকুরে মাছ ধরা, সাঁতার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মানুষকে পুকুরকেন্দ্রিক কাজে উৎসাহী করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। মালিকানা নিয়ে জটিলতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট নগর কর্তৃপক্ষের সাহায্য চাওয়া হয়। ফলে, এই বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করা জরুরি। ঢাকার অধিকাংশ পুকুরের পানি দূষিত, পাড় দখল ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুকুরগুলোর অবস্থা সংকটাপন্ন- এটি এড়ানো যাবে না। ফলে, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিশ্চিত হোক এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।