বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

রাষ্ট্র সংস্কারের পূর্বশর্ত হিসেবে সংবিধান সংস্কার করতে হবে

মো. সবুজ মিয়া
  ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রাষ্ট্র সংস্কারের পূর্বশর্ত হিসেবে সংবিধান সংস্কার করতে হবে

সংবিধানকে একটি রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি বলা হয়। এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও মৌলিক আইন। একটি রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, সরকারে তিন বিভাগের মধ্যকার সম্পর্ক, ক্ষমতা ও কার্যবলি, জনগণের মৌলিক অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। এ জন্য সংবিধানকে রাষ্ট্রের দর্পণ বলা হয়। আয়নায় আমরা যেমন নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজে পাই, তেমনি একটি রাষ্ট্রকে পরিপূণভাবে জানতে হলে ওই রাষ্ট্রের সংবিধান পাঠ করা প্রয়োজন।

১৯৭২ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান রচিত হয়। এরপর প্রয়োজনের তাগিদে নানা সময় ১৭ বার সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু এতেও আশানুরূপ সফলতা আসেনি।

জুলাই বিপস্নব-পরবর্তী বর্তমান বাস্তবতায় রাষ্ট্র সংস্কারের ধারাবাহিকতায় সংবিধান সংস্কার করা অতীব জরুরি। এটা কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নয়; বরং জনগণের প্রয়োজনেই তা করতে হবে।

সংবিধান সংস্কারের সবচেয়ে সহজ পথ হলো- সংস্কারের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা। নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে। যেহেতু আমরা নতুন করে সংবিধান প্রণয়ন করছি না, তাই এর নাম দেওয়া যেতে পারে 'সংবিধান সংস্কার' নির্বাচন। অতীতে এরূপ নির্বাচন অনেক দেশেই হয়েছে। বাংলাদেশর বর্তমান সংবিধানও ১৯৭১ সালের পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক রচিত হয়।

তবে নির্বাচনের বিকল্প হিসেবে রাজনৈতিক দল, চাপ সৃষ্টিকারী দল, সুশীল সমাজ থেকে সংবিধান সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ গ্রহণ করা যেতে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিত সংস্কার কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানাদির প্রায় সবই রয়েছে। সার্বজনীন ভোটাধিকার, নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন- সবই রয়েছে। কিন্তু তা সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতত্ত্বের কাছে বন্দি। যদিও নির্বাচন কমিশনার সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্বাচিত হন, তবে তা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। অনুরুপভাবে, আমাদের আইনসভা জাতীয় সংসদও ৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে দলীয় শৃঙ্খলার মরপঁ্যাচে বন্দি হয়ে আছে। যা আইনসভার কণ্ঠরোধ করার শামিল।

সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকলেও সংবিধানের ১৪১ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে যেকোনো সময় তা রহিত করতে পারে। যা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।

তেমনি বাংলাদেশে সংবিধানে ৫৩ (২) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতির দুই মেয়াদের অধিক নির্বাচিত না হওয়ার বিধান থাকলেও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন নিয়ে এরূপ কোনো বিধান নেই। ফলে প্রধানমন্ত্রী যতবার ইচ্ছা নির্বাচিত হতে পারে। এ ছাড়া সংবিধানের ৫৬ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী যেরূপ সংখ্যক ইচ্ছা সেরূপ সংখ্যক মন্ত্রীদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সংবিধান অনুযায়ী একই সঙ্গে তিনি জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা উভয়ের নেতা। ফলে জাতীয় সংসদে আইনসভার প্রাধান্যের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতান্ত্রিক শাসন বেশি কার্যকর হয়।

একইভাবে আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগ, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, মূলনীতি সবই আছে; কিন্তু বিভিন্ন কৌশলে, বিভিন্ন অনুচ্ছেদ ও আইনের মারপঁ্যাচে এক ব্যক্তির ইচ্ছার কাছে বন্দি হয়ে আছে। তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়, কিন্তু সবাই তার কাছে জবাব দিতে বাধ্য। যা একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অনুরূপ। সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে এই ইচ্ছাতত্ত্বের অবসান ঘটাতে হবে। আমরা যদি একটি কার্যকরি আইনসভা চাই, তাহলে আইনসভার কণ্ঠরোধকারী ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করতে হবে। জনস্বার্থ কাজ করে এরূপ কার্যকরী প্রশাসন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, জনগণের মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে চাইলে, কিংবা স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে চাইলে সংবিধানে সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো পরিবর্তন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সংবিধান সংস্কার।

সংবিধান সংস্কার ব্যতীত বাংলাদেশের বিদ্যমান সংকট থেকে বের হওয়ার বিকল্প কোনো পথ নেই। বিভিন্ন অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে হয়তো সংকটকে সাময়িক ধামাচাপা দেওয়া যাবে, কিন্তু অচিরেই তা আরও বড় সংকট আকারে হাজির হবে। নতুন করে একনায়কতন্ত্রের সূচনা হবে।

বিশ্বের অপরাপর দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য রাষ্ট্রকে যুগোপযোগী গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কার তথা রাষ্ট্র সংস্কার। যা একমাত্র সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমেই সম্ভব।

মো. সবুজ মিয়া

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে