শিক্ষকতা একটি প্রামাণ্য শিক্ষাগত দায়িত্ব। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, শিক্ষকতা হলো একটি ব্রত, একটি আদর্শ, একটি নৈতিক মানদন্ড। কোনোভাবেই একে কলঙ্কিত করা যাবে না। জন অ্যাডামস শিক্ষককে 'গধশবৎ ড়ভ গধহ' বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, 'শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রূপকার।' একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন চরিত্রবান। তিনি আদর্শের প্রতীক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই প্রসঙ্গে বলেছেন, 'তাদের চরিত্রে, কথায় ও কাজে কোনো পার্থক্য থাকবে না।' শিক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম- যা সমাজের সবচেয়ে মৌলিক স্তরের উন্নতি ও উন্নত সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। আর এখানে শিক্ষার আসনে যিনি বসে থাকেন এবং সমাজের সবচেয়ে মৌলিক স্তরের উন্নতি ও উন্নত সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যান তিনিই শিক্ষক। 'যিনি জানেন, তিনি করেন, যিনি বোঝেন, তিনি পড়ান ' অ্যারিস্টোটল। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষকরা হলেন স্নায়ুতন্ত্র- যার ভেতর দিয়ে সব সময় প্রবাহিত হয় জ্ঞানের নতুন ধারা, নতুন সভ্যতা। সভ্যতার সুচারু কারিগর হলেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক সর্বদাই মানবিক ও নৈতিক। তিনি কখনোই ব্যবসায়িক চিন্তা করেন না এবং ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে সাময়িক উন্নতির চিন্তায় রত থাকেন। তিনি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধী এবং সার্বজনীন ও মানসম্মত শিক্ষার নিরলস প্রচেষ্টায় মত্ত থাকেন। যিনি শিক্ষক তার পক্ষে শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীর কোনোরকম ক্ষতি সাধন সম্ভব হয় না। তিনি সর্বদা সৃজনশীল, অধিকার চেতা। তিনি ছাত্রদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বপ্নের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখান, ছাত্রের ভেতরকে জাগিয়ে তোলেন, সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করেন। শিক্ষক সেই যিনি সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমম্পর্ক এবং পরিবেশ সৃষ্টিতে বা তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। যিনি প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেন সত্য এবং সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে। যার কাছ থেকে ছাত্ররা সত্যকে সত্য বলতে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শিখে, বলার সাহস সঞ্চয় করে। একজন শিক্ষকই সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যিনি শিক্ষক তিনি কখনোই ছাত্রদের শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। শিক্ষক-শিক্ষিকা মা-বারর পরে এই মানুষের আমাদের হাঁটতে শিখান সঠিক পথে। না তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও আমাদের কোনো সাফল্যে তাদের চোখ জলে ছলছল করে। মা-বাবার পরে তারাই হউক আমাদের শ্রেষ্ঠ উপহার।
শিক্ষক শব্দটি বহুরূপীভাবে সম্পর্কিত। তার মূল অর্থ হলো 'শেখানো' বা 'শিখানো'। শিক্ষক তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, সংস্কার, এবং নৈতিক মূল্যগুলো স্থাপন করতে দায়ী হন। তারা একজন ভৌগোলিক এলাকা থেকে অন্যত্র শিক্ষা দেন এবং তাদের শিক্ষার্থীদের জীবনে পরিবর্তন উপস্থাপন করেন। শিক্ষকরা একটি সমৃদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা আত্মপ্রসূত শিক্ষা পদ্ধতিতে কাজ করতে পারেন। শিক্ষকতার মূল দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের শেখানো, উন্নত করা এবং তাদের নৈতিক আত্মবিশ্বাস উন্নত করা। এছাড়া, শিক্ষকদের কাছে অধ্যাপনা এবং শিক্ষার প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ, বিদ্যার্থীদের একটি উপস্থিতি স্থাপন, শিক্ষার উন্নতিতে সহায়ক ও প্রোৎসাহন দেওয়া এবং তাদের জীবনে একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা। শিক্ষা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একজন ব্যক্তির জীবনে স্বপ্ন এবং লক্ষ্যের দিকে নেমে যায়। শিক্ষা দ্বারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতি সম্ভব হয়; এটি একটি সুস্থ ডেমোক্রেটিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ মূল্যগুলো প্রতিষ্ঠাপনে সাহায্য করে। শিক্ষা ব্যবস্থা সমৃদ্ধির জন্য একটি কুঁড়েঘর। এটি সমৃদ্ধির সাধারণ উপায়, বিশেষভাবে শিক্ষা প্রদান, শিক্ষার মান, এবং শিক্ষার উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। সরকার এবং সমাজ শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে দায়ী হয়ে উঠে, শিক্ষা প্রণালি নির্ধারণ এবং পর্যায়ক্রম ব্যবস্থা করে তুলতে সাহায্য করে। শিক্ষকতা আমাদের সমাজের উন্নতি এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক স্বরূপে সম্পর্কিত এবং মানসম্মতভাবে উন্নত করতে সাহায্য করে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রণালিও একটি শক্তিশালী ও উন্নত অংশ হয়ে উঠে- যা আমাদের সমাজের উন্নতির দিকে নিয়ে যায়।
শিক্ষকতা একটি সমাজের শিক্ষার্থীদের জীবনে অমূল্য মূল্য যোগাযোগ তৈরি করে, তাদের বৃদ্ধি ও উন্নতির দিকে প্রাণস্পর্শী ভূমিকা পালন করে। শিক্ষক একটি দুর্মিল পেশার প্রতিষ্ঠাতা, একটি নির্মাতা, একটি গবেষক, একটি পরিশ্রমী, একটি গুরু এবং একটি প্রেরণাস্ত্রোত। এই পেশার মাধ্যমে শিক্ষক নতুন প্রজন্মের জীবন প্রস্তুত করে তোলে এবং তাদের সমৃদ্ধি ও সামাজিক জীবনে সঙ্গে নেয়। শিক্ষকতা একটি মানসম্মত পেশা, কারণ এটি নতুন প্রজন্মের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত যোগাযোগ যাত্রা, শিক্ষকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সময় এবং দিনের শেষে প্রত্যেকটি ছাত্রের কৌশল ও জ্ঞানে পরিণত হওয়ার সময় হয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বৃদ্ধি এবং উন্নতি নির্ধারণ করা, তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে সাহায্য করা, তাদের জীবনে সমস্যার সমাধানে সাহায্য করা, উৎসাহ, সমর্থন প্রদান করা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রস্তুত করা। এই দায়িত্বগুলো একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত যত্ন ও সমর্থনের মাধ্যমে পালন করা হয়- যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের সর্বোত্তম স্বপ্ন এবং লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। একজন মানসম্মত শিক্ষক হতে হলে, শিক্ষকের ব্যক্তিগত ও পেশাগত সমর্থন নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিক্ষকের নিজের শিক্ষাগত প্রস্তুতি, তার অধ্যাপনা দক্ষতা, এবং সমাজের প্রতি একটি দায়িত্বমূলক বৈচিত্র্যের সঙ্গে যোগাযোগ সাধন করে। শিক্ষকরা নতুন প্রজন্মের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির সঙ্গে একটি সামর্থ্যপূর্ণ সমাজ নির্মাণ করতে সাহায্য করে এবং আমরা সমাজে উন্নতি এবং উন্নতির দিকে একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
একজন শিক্ষকের ভূমিকা ও দায়িত্ব অফুরন্ত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়াই মুখ্য। তারা আমাদের জীবনকে স্পর্শ করে আর আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। শিক্ষকদের অর্জিত বিদ্যা শিক্ষার্থীর মধ্যে কাঙ্কিত মান অনুযায়ী সঞ্চারিত করা খুব সহজ কথা নয়। শিক্ষকের শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হলো টেকসই জ্ঞান ও অনুসন্ধান। এসবের প্রতিফলন ঘটে চর্চার মাধ্যমে। অন্যদিকে, শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক দক্ষতা আর বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের শিক্ষা। শিক্ষার বিভিন্ন দর্শন, মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, শিক্ষার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমি, আর্থসামজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষার অনুশীলন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। একজন শিক্ষকের স্বপ্ন তার ছাত্ররা তাকে একদিন অতিক্রম করবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজে এ ধরনের শিক্ষকের বড়ই অভাব। তবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং সমাজ উন্নয়নে সব শিক্ষকেরই ভূমিকা থাকবে এমনটি নয়। একজন শিক্ষক আদর্শ মানবসৃষ্টির শৈল্পিক কারিগরও বটে এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দেশনা ও আদর্শ-জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হয়। তাই বলা হয়, ব্যক্তি মানব এখানে অর্থহীন। কিন্তু ব্যক্তি শিক্ষক সবার শ্রদ্ধার ও সম্মানের পাত্র। তাছাড়া, শিক্ষক সমাজ সর্বজনীন, কল্যাণকর ও প্রভাবশালী সচেতন প্রতিনিধি। এক্ষেত্রে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক কর্মকান্ডে নেতৃত্বদান, সংগঠিত মনোভাব সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। শিক্ষককে সমাজে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সামাজিকতা, জনসচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে নেতৃত্বদান, জনমত গঠন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, সামাজিক বিবাদ-মীমাংসা, অপরাধ প্রবণতা রোধে করণীয় নির্ধারণ এবং সামগ্রিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কর্মকান্ডে ভূমিকা পালন করতে হয়। শিক্ষকরা নতুন প্রজন্মের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির সঙ্গে একটি সামর্থ্যপূর্ণ সমাজ নির্মাণ করতে সাহায্য করে এবং সমাজে উন্নতি এবং উন্নতির দিকে একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সমস্ত কিছুর মধ্যে, শিক্ষকতা একটি প্রতিষ্ঠিত পেশা এবং এটির প্রতি সমর্পণ এবং সমর্থন প্রদান করা উচিত। সমর্থ শিক্ষকরা নতুন প্রজন্মের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির সঙ্গে একটি সামর্থ্যপূর্ণ সমাজ নির্মাণ করতে সাহায্য করে, আমরা সমাজে উন্নতি, উন্নতির দিকে একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
শিক্ষকতা নামমাত্র জ্ঞান প্রদানের কাজ করে, বরং আপনি সমাজের নবীন প্রজন্মকে নীতি, মর্যাদা, মানবিকতা এবং ব্যক্তিগত উন্নতির দিকে নির্দেশনা দেন। একজন শিক্ষক সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান, যোগ্যতা, সুবিধা প্রদান করে তাদের শিক্ষা ও আত্মোন্নতির পথে সঙ্গে থাকেন। তার দায়িত্ব্ব ছাত্রদের পঠন, লেখা, কথন, বোঝার দক্ষতা তৈরি করা, তাদের চরিত্র এবং ব্যক্তিগত উন্নতি উন্নত করা, সামাজিক মূল্যমান ও নীতিগত শিক্ষা দেওয়া। শিক্ষকতাকে একটি মহৎ ও মানবিক পেশা হিসেবে গণ্য করা হলেও শিক্ষণ প্রক্রিয়া অনেক জটিল কাজ। শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয় বরং সমাজ ও দেশের এক ধরনের সেবা। একজন সফল শিক্ষক হওয়ার জন্য কেবল বিষয়সংশ্লিষ্ট জ্ঞান ও শেখানো পদ্ধতি বিষয়ক জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে বিষয়গত জ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও জানা দরকার। শিক্ষকের পেশাগত শিক্ষা এমন হবে- যা শুধু শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও শ্রেণি ব্যবস্থাপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তার পড়াশোনার পরিধি হবে ব্যাপক। আর আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে আগ্রহ থাকবে অফুরন্ত। সেই সঙ্গে চিন্তা ও বিবেচনাবোধ থাকবে সীমাহীন। শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের জানতে ও বুঝতে হবে এবং তার সব কর্মকান্ডে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত হবে। তবে উন্নত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকের আর দক্ষ শিক্ষক তৈরি করার জন্য দরকার উন্নতমানের শিক্ষা ব্যবস্থা।
প্রাচ্যদেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সব সময়ই গুরু-শিষ্যের মতো ছিল। প্রাচীন ভারতের নালন্দা থেকে শুরু করে সোমপুর বৌদ্ধবিহার ও শালবন বৌদ্ধবিহার এবং নিকট অতীতের পন্ডিত সমাজ থেকে শুরু করে মাদ্রাসাভিত্তিক মৌলভী-ছাত্রের সম্পর্ক ও গুরু-শিষ্যের পরস্পরকে মনে করিয়ে দেয়। যেখানে একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে একাডেমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে নীতি-আদর্শ শিষ্টাচারসহ ব্যবহারিক জীবনের সব ধরনের দিকনির্দেশনায় দীক্ষিত করেন। আর ছাত্র তার গুরুর সেই শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করে ভবিষ্যৎ জীবনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা শিক্ষকের অনুপ্রেরণা ও রোল মডেল অনুসরণ করেন। যেহেতু শিক্ষক এমন একজন ব্যক্তি যিনি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেন, সেহেতু শিক্ষক স্কুল ও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রদান করেন। বর্তমান সময়ে ছাত্র-শিক্ষকের সেই চিরায়ত সম্পর্কে যেন চিড় ধরেছে। এর কারণ, এখন শিক্ষক কোনো আদর্শ ব্যক্তিত্ব নন আর ছাত্রও অনুগত শিষ্য নয়। বর্তমানে ছাত্র ও শিক্ষক অনেক ক্ষেত্রে যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষকের ভূমিকা নিষ্ক্রিয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্রই শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। এতে রাষ্ট্রের মর্যাদার তেমন কোনো ক্ষতি হয় না বলে অনেকে মনে করে কিন্তু এই ধারণা একেবারেই ভুল। শিক্ষকতা পেশা সারা বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত চাকরিগুলোর মধ্যে একটি। তাই শিক্ষকদের সম্মানার্থে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস পালিত হয়। এ দিবসটি শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পালন করা হয়।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থা এবং ছাত্র-শিক্ষকের দূরত্বরপূর্ণ সম্পর্কের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পাশপাশি শিক্ষকরাও কম দায়ী নন। বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতি নিয়ে কথা বলতে নেই, টিউটোরিয়াল-অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে নেই, পরীক্ষার সময় নকল ধরতে নেই, ব্যবহারিক-মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্ন করতে নেই, ক্লাসে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ে ধমক দিতে নেই, চুলের ফ্যাশন ও পোশাক নিয়ে কথা বলতে নেই এবং শিষ্টাচার শেখাতে নেই। সর্বোপরি কোনো হিতোপদেশও দিতে নেই। উলেস্নখ্য, আতঙ্ক (১৯৮৬) চলচ্চিত্রে ন্যায়নিষ্ঠ অধ্যাপক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একটি বাণী এখানে মেনে চলতে হয়-'মাস্টার মশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।' বর্তমান সমাজে শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষমতা যেখানে মুখ্য হওয়ার কথা ছিল, সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষাকে একরকম পরিত্যাগ করে প্রশাসক হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাচর্চায় নিজেদের যুক্ত করছেন। শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহ কমছে, ক্ষমতার চর্চা বাড়ছে- যা শিক্ষার চিন্তা ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ১৯৫২ সালে ইসরাইলের প্রথম প্রেসিডেন্ট ওয়াইজম্যানের মৃতু্যর পর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু যার মধ্যে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আনন্দ নেই, তার কাছে ক্ষমতা মূল্যহীন। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গবেষণাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আমাদের শিক্ষকরাও যদি এমন ভাবতে পারতেন, তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান অন্বেষণ করা সম্ভব হতো। আমাদের দেশে শিক্ষকসমাজ যদি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে আন্তরিকতা, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা ও সততার মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করত, তাহলে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হতো। সর্বোপরি, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব হতো। শিক্ষকদের অবহেলা করে, তাচ্ছিল্য করে, লাঞ্ছিত করে সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া আর সম্ভব হতো না। শিক্ষকতা একটি মানসম্মত পেশা হলেও এটি বৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নতির দিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সঠিক সমর্থন ও স্বাধীনতা প্রদান করা দরকার। শিক্ষকদের প্রশাসনিক ও আর্থিক সমর্থন বাড়িয়ে দেওয়া আবশ্যক- যাতে তারা স্বাধীনভাবে শিক্ষা প্রদান করতে পারেন এবং তাদের উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিকে প্রবৃদ্ধি দেতে সক্ষম হতে পারেন। সর্বশেষ এইটুকু বলি- শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, শিক্ষকতা হলো একটি ব্রত, একটি আদর্শ, একটি নৈতিক মানদন্ড। শিক্ষার উন্নতি করতে হলে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার পাশপাশি শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আন্তরিকতা, মানদন্ড ও নৈতিকতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকতা পেশাকে যে দেশ যত বেশি মর্যাদা দিয়েছে সেই দেশ ততো বেশি উন্নত হয়েছে।
সুধীর বরণ মাঝি : শিক্ষক ংযঁফরৎথপযধহফঢ়ঁৎ@ুধযড়ড়.পড়স