বিদায় নিল ২০২৪ সাল। স্বাগত ২০২৫। নতুন বছর নতুন কল্যাণময়ে শুরু হোক আমাদের পথচলা। ২০২৪ সাল শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। ছাত্র-জনতার অদম্য লড়াই আর হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ হায়নার গ্রাস থেকে মুক্ত হয়েছে।
২০২৪ বাংলাদেশকে বিশ্বের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নবীন প্রজন্ম এক দানবের মুঠো থেকে দেশকে ছিনিয়ে এনেছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ লড়াই ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমকালীন বিশ্বের বিরল এক গণ-অভু্যত্থানের মাধ্যমে দেশ স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়েছে। জনতার এই অভু্যত্থান গোটা বিশ্বকে অবাক করেছে।
২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল বছর। এই বছরটি ইতিহাসে জুলাই গণঅভু্যত্থান এবং স্বৈরাচারের পতনের বছর হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। ১৫ বছরের স্বৈরাচার হটানোর এটি ছিল চূড়ান্ত পর্ব। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ধাপে ধাপে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার উৎখাতের এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়।
২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়। জুলাইয়ে মাঝামাঝি থেকে এই আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ধারাবাহিক এই আন্দোলন ৩ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়।
এই আন্দোলনে তৎকালীন শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার ভয়াবহ দমন নিপীড়ন শুরু করলে এটি অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণ-অভু্যত্থানের মুখে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পলায়ন করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ এ সময় সাংবিধানিক সংকটে পড়ে এবং এর তিন দিন পরে নোবেল বিজয়ী, বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্র্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে গঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদ।
বাংলাদেশের জনগণ এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েয়েছেন ১৯৮ বিশ্ব নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ অন্তত ৯২ জন নোবেল বিজয়ী। ৪ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে ওই ১৯৮ বিশ্ব নেতার স্বাক্ষরসহ একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিশ্ব নেতারা বলেছেন, 'আমরা নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।'
তারা বলেন, 'বাংলাদেশের অন্যদের মতো অধ্যাপক ইউনূসও স্বৈরাচারের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রের বিদায়ের পর তিনি সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন।'
'আমরা বছরের পর বছর ধরে অধ্যাপক ইউনূসকে সমর্থন দিতে পেরে গর্বিত। এটা বাংলাদেশে নতুন সূর্যোদয়ের সূচনা। আমরা সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শান্তি এবং সাফল্য কামনা করছি।'
নতুন বছরে আমাদের অতিপরিচিত অভিবাদন- হ্যাপি নিউইয়ার কিংবা শুভ নববর্ষ। নতুন বছরটি ভালো কাটুক, বছরের প্রতিটি দিন সুখ ও শান্তিতে ভরে ওঠুক, আমরা এমনটি চাই; নিজের জন্যেও চাই। চাই অন্যের জন্য, আত্মীয়স্বজন, আপনজন, বন্ধুবান্ধব এবং নির্বিশেষে সবার জন্য।
\হএ পৃথিবীতে সবাই স্বীকার করবেন, জীবনে এগিয়ে যেতে হলে পেছনের ভুলত্রম্নটিগুলো চিহ্নিত করে সামনের দিনগুলোতে সেগুলো শুধরে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অতীতের ভুল থেকে যদি কেউ শিক্ষা না নেয় তাহলে ব্যর্থতার গ্রাস থেকে মুক্তির কোনো পথ তার নেই। এ কথা একান্ত ব্যক্তিজীবনে যেমন সত্য, তেমনি সত্য ব্যক্তিজীবনের গন্ডি পেরিয়ে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলেও।
আছে দুঃখ, আছে মৃতু্য, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। - কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এ কথার মতই দুঃখ, কষ্ট সবকিছু কাটিয়ে নতুন জীবনের দিকে যাত্রার প্রেরণা নেবে মানুষ। নতুন বছরটি যেন সমাজ জীবন থেকে, প্রতিটি মানুষের মন থেকে সব গস্নানি, অনিশ্চয়তা, হিংসা, লোভ ও পাপ দূর করে। রাজনৈতিক হানাহানি থেমে গিয়ে আমাদের প্রিয় স্বদেশ যেন সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। নতুন বছরটি আনন্দে, শান্তিতে ভরে উঠুক- এই প্রত্যাশা।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।