সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

'কোটা না মেধা? মেধা মেধা'

সাধারণ দেশবাসী যেমন বিভিন্ন পেশায় তার মেধাবী সন্তানদের চায়, তেমনই রাষ্ট্রযন্ত্র নির্মাণে অবশ্যই মেধাবী কর্মকর্তাদের চাইবে। তাহলে এই চাওয়ার সঙ্গে কোটা পদ্ধতি কি সাংঘর্ষিক নয়? এটাকে কেন দুই গ্রম্নপের দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে?
ড. আবুল হাসেম আনসারী
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
'কোটা না মেধা? মেধা মেধা'
'কোটা না মেধা? মেধা মেধা'

ঐতিহাসিক জুলাই বিপস্নবের সূচনা হয়েছিল কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। সারাদেশের মানুষ তাতে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছিল, কারণ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ তারা তাদের মেধাবী সন্তানদের হাতে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিল। বিপস্নব সফল হয় এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তার মেধাবী সন্তানদের দ্বারা সমৃদ্ধ হবে, আমরা সেই প্রত্যাশা করি।

রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ স্টেক হোল্ডার রাষ্ট্রযন্ত্রের জনবল। সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল উপকরণ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ- যা উপসচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সর্বোচ্চ পদ সচিব পর্যন্ত সজ্জিত। রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলো কোনো নির্দিষ্ট পেশাজীবীদের নয়, এগুলো সরকারের পদ। যে কোনো সরকারি কর্মচারী যোগ্যতার ভিত্তিতে এই পদে আসীন হতে পারেন। পরীক্ষা দিয়ে মেধার ভিত্তিতে ডিএস পুল (উপ-সচিব পুল) এ প্রবেশের মাধ্যমে সরকারের কাজে অংশগ্রহণ করে জনবান্ধব পাবলিক সার্ভিস গঠিত হবে, এই সবার প্রত্যাশা!

দেশে চলমান ক্যাডার বৈষম্য আন্দোলন এই চাহিদারই প্রতিফলন- যেটাকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে বাদবাকি ২৫ ক্যাডারের দ্বন্দ্ব বলে অনেকেই ভুল করছেন। সরকারের কাজ জনহিতকর, এখানে দ্বন্দ্বের কিছু নেই। কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। কিন্তু পূর্বে থেকে ৭৫ শতাংশ কোটার মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডার উপ-সচিব পুল দখল করে রেখেছে আর বাদবাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থেকে মাত্র ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়ে থাকে। যদি রাষ্ট্রের চোখে সব সরকারি কর্মচারী সমান হয়ে থাকেন, তাহলে এটা কি বৈষম্য নয়? যখনই কোটাবিরোধী অবস্থান নিয়ে মেধার ভিত্তিতে ডিএস পুল ওপেন করার কথা বলা হলো, তখনই পূর্ব থেকে কোটা সুবিধা ভোগ করে সরকারের পদগুলোতে আরোহণ করা প্রশাসন ক্যাডারদের স্বার্থে আঘাত লেগে গেল, ফলে অবধারিতভাবে এটা দুই গ্রম্নপের বিবাদ হিসেবে চিহ্নিত হলো।

এখন আসুন, কোটা সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে কি বলা হয়েছে! বলা হয়েছে রাষ্ট্র কারও প্রতি বৈষম্য করবে না, রাষ্ট্রের চোখে সবার সমানাধিকার বিদ্যমান। তবে পিছিয়ে যাওয়া পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখা থেকে এই আইন রাষ্ট্রকে বিরত করবে না। কি সুন্দর কথা!!! অর্থাৎ অচল অক্ষম বা প্রতিবন্ধী কোনো সম্প্রদায় বা পেশাজীবীদের অগ্রায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোটা পদ্ধতি রাখতে পারবে।

বিসিএস এমন একটা পরীক্ষা- যার মাধ্যমে রাষ্ট্র বিভিন্ন সেক্টরে সরকারি কর্ম পরিচালনার জন্য তার মেধাবী সন্তানদের নির্বাচন করে থাকে। যেহেতু বিসিএস পরীক্ষায় বেশিরভাগ সাধারণ ক্যাডারে পরীক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ থাকে প্রশাসন ক্যাডার, সেহেতু এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মেধা নিয়ে অবশ্যই কোনো সন্দেহ নেই, নিঃসন্দেহে তারা মেধাবী। তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র নির্মাণে কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাদের কেন সরকারের পদগুলোতে প্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ করতে হবে? সমসাময়িক অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে মেধার ভিত্তিতে ডিএস পুলে প্রবেশ করতে আপত্তি কোথায়?

সাধারণ দেশবাসী যেমন বিভিন্ন পেশায় তার মেধাবী সন্তানদের চায়, তেমনই রাষ্ট্রযন্ত্র নির্মাণে অবশ্যই মেধাবী কর্মকর্তাদের চাইবে। তাহলে এই চাওয়ার সঙ্গে কোটা পদ্ধতি কি সাংঘর্ষিক নয়? এটাকে কেন দুই গ্রম্নপের দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে?

আরেকটি বিষয় আসে এখানে সরকারের কাজে দক্ষতা। নিজ নিজ ক্যাডারের কাজে সবাই দক্ষ- যার যার পেশায় সবাই-ই অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন। কিন্তু সরকারের মূল কাজ নীতিনির্ধারণ করা। উপ-সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সরকারের কর্মকর্তারা এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সেই কাজ স্ব স্ব ক্যাডারের কাজ থেকে ভিন্ন। উপ-সচিব হওয়ার পরে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সেমিনার, স্টাডি, বিদেশ প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার পরিচালনার তথা নীতিনির্ধারণী কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি হয়। সেটা মেধার ভিত্তিতে যে কোনো ক্যাডার থেকে এসে অর্জন করা সম্ভব। দক্ষতা কেউ নিয়ে জন্মায় না, জন্মানোর পরেই মানুষ দক্ষতা অর্জন করে। তাই এটাকে দুর্বল যুক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় নিঃসন্দেহে।

আরেকটা অজুহাত দেওয়া হয় প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষ থেকে, যেটা হলো ২০০২ সালে আদালতের একটা রায়। কী বলা হয়েছে সেই রায়ে? সেখানে বলা হয়েছে কোটা সংরক্ষণ একান্তই সরকারের বিষয়। সরকার চাইলে ১ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত কৌটা রাখতে পারবে, তাহলে ৭৫ শতাংশ আর ২৫ শতাংশ এলো কোথা থেকে? এটা সরকারের পক্ষ থেকে পরিপত্র দিয়ে করা হয়েছে। তাই না? তাহলে এখন পরিপত্রের মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি বাতিল করা যাবে, এখানে আদালতের রায়ের ব্যত্যয় হচ্ছে না।

দেশে চলমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের দাবি অনুযায়ী সরকারের পদগুলোকে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ না করে তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক, তাতে মেধার ভিত্তিতে ডিএস পুলে কর্মকর্তাদের আগমন ঘটুক, সেটা আল্টিমেটলি দেশ তথা জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

ড. আবুল হাসেম আনসারী : সহকারী পরিচালক (অব.)

কুমিলস্না মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে