সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। দেশ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ধরন। এই পরিবর্তনগুলো বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং কমিউনিটির জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করে।
মেজর মো. শাহরিয়ার হাসান, পিএসসি
  ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশ
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত একটি দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু পরিস্থিতি এবং আর্থসামাজিক কারণে দেশটি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদী ভাঙন, ভূমিধস এবং খরার সম্মুখীন হয়- যা উলেস্নখযোগ্যভাবে এর জনসংখ্যা এবং অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। এই দুর্যোগের প্রভাব কমাতে কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে বলতে গেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় দুর্যোগের সময় মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করার জন্য গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও কর্মকান্ড। দুর্যোগ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প), মানবসৃষ্ট দুর্যোগ (যুদ্ধ, আগুন, রাসায়নিক দূষণ) ইত্যাদি। এই ঘটনাগুলোকে দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়- যা সমগ্র পরিবেশকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির কারণ। বাংলাদেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর ব-দ্বীপে অবস্থিত- যার ফলে, বর্ষা মৌসুমে প্রায় সব সময় এ দেশে বন্যা দেখা যায়। উপরন্তু, বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তিতা এটিকে ঘূর্ণিঝড় ও মৌসুমি ঝড়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। সমতল ভূমির আধিক্য এবং উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এই দুর্যোগের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

বাংলাদেশ ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ২৫০টির ও বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে; যার ফলে, $৩০ বিলিয়নেরও বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর আমাদের জিডিপির প্রায় ১.৮ শতাংশ ক্ষতি হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে, আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ মিলিয়ন বার্ষিক বন্যা, ৮ মিলিয়ন খরা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের ৮ শতাংশ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে পস্নাবিত হতে পারে।

১৯৭০-২০১৯ সাল পর্যন্ত, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছে, তারপরেই বন্যার অবস্থান। অবশিষ্ট দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে ভূমিধস, খরা, নদীর তীরের ভাঙন, মহামারি, ভূমিকম্প ইত্যাদি। আগস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৮৮ সালের বন্যায় ৮৯০,০০ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ১৫১৭ জনের মৃতু্য হয়েছিল। ১০ বছর পর, ১৯৯৮ সালে আরেকটি বিধ্বংসী বন্যায় ৫৩টি জেলায় ০.০১ মিলিয়ন বর্গকি.মি. এলাকা পস্নাবিত হয়। যার ফলে, ৯১৮ জন এর প্রাণহানি ঘটে। ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কিছু প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়; যার ফলে, জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বু্যরোর মতে, দেশটি গত কয়েক দশক ধরে অসংখ্য উলেস্নখযোগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে; যার ফলে, প্রাণহানি, বাস্তুচু্যতি এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ (ডিএম অ্যাক্ট) উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক। আইনটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে এবং উচ্চ স্তরের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল এবং স্থানীয় পর্যায়ে অন্যান্য কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করে। ডিএম অ্যাক্ট-২০১২ এ ফৌজদারি দন্ডের বিধান রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা কর্তৃপক্ষের জরুরি নির্দেশনা অমান্য করলে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা বা ৩ মাসের জেলের বিধান রয়েছে। এই আইন প্রণয়নের আগে, ১৯৯৭ সালের দুর্যোগ সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ (ঝঙউ) বাংলাদেশে 'দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বাইবেল' হিসেবে পরিচিত ছিল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি-২০১৫ এ কমিউনিটিভিত্তিক ঝুঁকি হ্রাস, দ্রম্নত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আইনটি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করার জন্য প্রাসঙ্গিক নিয়মগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম এবং ২০১৫ সালের নেপালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় (গড়উগজ) দুর্যোগ সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ (ঝঙউ), ২০১৯ প্রকাশ করেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অগ্রগতি সত্ত্বেও উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হল দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়ার জন্য সীমিত সংস্থান। বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রায়ই আর্থিক সীমাবদ্ধতা দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বাধা দেয়। অধিকন্তু, দেশটি অবকাঠামোগত উন্নয়নে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে মৌলিক পরিষেবা এবং সুযোগ-সুবিধা সীমিত। এই অবকাঠামোর অভাব দুর্যোগের সময় আশ্রয় প্রদান প্রচেষ্টা এবং সাহায্য বিতরণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। দেশ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ধরন। এই পরিবর্তনগুলো বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং কমিউনিটির জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করে।

বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো :পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম এবং পূর্বাভাস ব্যবস্থার অভাবে দ্রম্নত প্রতিক্রিয়া জানানো কঠিন হয়ে পড়ে। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার অভাব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাধা সৃষ্টি করে। দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাব দেখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের প্রকৃতি ও তীব্রতা বাড়ছে- যা পূর্বাভাস ও মোকাবিলার কৌশলকে জটিল করে তুলছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশ তার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সক্ষমতার উন্নতিতে অগ্রগতি অর্জন করেছে। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের জন্য বাংলাদেশ একটি সক্রিয় পন্থা গ্রহণ করেছে, এবং শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে প্রস্তুতি এবং প্রশমনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। বাংলাদেশ প্রথম ২০০৫ সালে ন্যাশনাল পস্ন্যান অব অ্যাকশন প্রণয়ন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা সেপ্টেম্বর ২০০৯, ছয়টি 'স্তম্ভ'-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল তা হলো খাদ্য নিরাপত্তা, ব্যাপক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, কম কার্বন নির্বাপণ ইত্যাদি। ন্যাশনাল পস্ন্যান ফর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট (ঘচউগ) -২০২১-২৫ এর মতো উদ্যোগগুলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্যোগের পরবর্তী ক্ষতি কমানোর জন্য কৌশলগুলো রূপরেখা দেয়। ন্যাশনাল পস্ন্যান ফর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট (ঘচউগ) -২০২১-২০২৫ এর মূল লক্ষ্য হলো দুর্যোগে মৃতু্য হার কমানো, অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাস। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে তা হলো দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো, দ্রম্নত প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা, জরুরি পুনরুদ্ধার ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ সেন্ডাই ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বর্তমান ধারণা, যার মধ্যে রয়েছে প্রতিরোধ, প্রস্তুতি, প্রতিক্রিয়া, পুনরুদ্ধার, প্রশমন, পুনর্বাসন এ পদ্ধতি অনুসরণ করে। এছাড়াও বাংলাদেশ জলবায়ু কূটনীতিতে সব সময়ই প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০২২ সালের মিশরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন (ঈঙচ ২৭) এবং পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালের আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ঈঙচ ২৮ বৈঠকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু কূটনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সাফল্যের সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য পরিমাপ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানির উলেস্নখযোগ্য হ্রাস। ২০০৭ সালে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় সিডর এ সর্বমোট ৩৫০০ জন নিহত এবং প্রায় ৫৫,০০০ জন আহত হয়েছিল। কিন্তু মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালে সংঘটিত আইলা ঘূর্ণিঝড় এ ১৯০ জন নিহত হয় এবং প্রায় ৭,০০০ জন আহত হয়েছিল। ২০২০ সালে সংঘটিত ২৬০ কিলোমিটার গতির আম্ফানে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৬ জন। ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। এই ধরনের সাফল্যের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিপর্যয় সংক্রান্ত ব্যাপক স্থায়ী আদেশ এবং পরবর্তী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন।

বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে দক্ষতার সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারি সংকট মোকাবিলা করেছে। মিয়ানমারের ১.২ মিলিয়ন নির্যাতিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের (২০১৭ সাল থেকে ৭৫০,০০০ নতুন আগত রোহিঙ্গা নির্বাসন) পরিচালনা করা হয়েছে। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় -এর নির্দেশে, অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা সংক্রান্ত সমস্ত কার্যক্রম সমন্বয় করে থাকে। রোহিঙ্গা শিবিরে কোভিড-১৯ মহামারি এতটাই দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা হয়েছে যে সেখানে ৫০ জন এর ও কম লোক মারা গেছে। অন্যান্য অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রামিত ব্যক্তির সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল।

ইউএনডিপি এবং জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা, বৈশ্বিক বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় এনজিও, দ্বিপক্ষীয় দাতা, মানবিক সংস্থাগুলো আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের দুর্যোগ-সংক্রান্ত কর্মকান্ডে সহায়তা করে আসছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (অউই), এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা প্রদান করে। তারা প্রযুক্তিগত সহায়তা, তহবিল প্রদান এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো বড় পরিমাণ অর্থ এবং বড় সহযোগিতার মাধ্যম। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বেসরকারি খাতকে তাদের অর্থ বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পারে অথবা দুর্যোগে দ্রম্নত সাড়া দেওয়ার জন্য কিছু স্থানীয় সংস্থাকে অর্থায়ন করতে পারে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ের থেকে স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন অপরিহার্য। এশিয়ার দেশ নেপাল দুর্যোগ পরিচালনায় স্থানীয় সরকারের কাছে দায়িত্ব প্রদান করে। উন্নত দেশ যুক্তরাজ্যতেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা অর্পিত। কেন্দ্রীয় সরকার সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে এবং নির্দেশনা প্রদান করে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এবং কৃষিভিত্তিক শ্রমিকদের সুরক্ষা মানে কৃষিভিত্তিক-অর্থনীতি রক্ষা করা। তাই দুর্যোগপ্রবণ এলাকাতে নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধে কৃষি শ্রমিকদের সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। এছাড়াও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে কৃষকরা যাতে দ্রম্নত পুনর্বাসিত হতে পারে ও উৎপাদন কাজে ফিরে যেতে পারে সেই সহযোগিতাও প্রদান করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় দুর্যোগের প্রকারের পার্থক্য রয়েছে। তাই দুর্যোগপূর্ণ এলাকাগুলোকে আর নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করতে হবে। তাহলে দুর্যোগপূর্ণ এলাকাগুলোতে আরও দ্রম্নত সহযোগিতা পৌঁছানো সম্ভব হবে।

জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সহায়তা করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সাহায্য ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য যথাযথ সম্মিলিত পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হবে না। সব মহল থেকে দুর্যোগের পূর্ব ও পরবর্তী প্রস্তুতি দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রম্নত সাড়া দিতে অপরিহার্য। এছাড়াও বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান মিডিয়ায় নিয়মিত প্রচার করা যেতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রতিটি কমিটি ও প্রতিষ্ঠান এর কার্যক্রম স্বচ্ছ এবং আরও জবাবদিহিতামূলক করা যেতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে পূর্বাভাস ব্যবস্থা উন্নত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো কমিউনিটি এর অংশগ্রহণ। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়া উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে জড়িত করে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে, কমিউনিটিকে দুর্যোগ ঝুঁকি এবং প্রতিক্রিয়া কৌশল সম্পর্কে শিক্ষিত করা যেতে পারে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)-এর মতো সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিকে একীভূত করা সাড়া দেওয়ার প্রচেষ্টাকে উলেস্নখযোগ্যভাবে উন্নত করা যেতে পারে। প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থা, ভৌগলিক তথ্য ব্যবস্থা (এওঝ) এবং মোবাইল অ্যাপিস্নকেশনগুলোর ব্যবহার জরুরি পরিস্থিতিতে যোগাযোগ এবং তথ্য প্রচারকে উন্নত করতে পারে। এই প্রযুক্তিগুলো সময়োপযোগী এবং সঠিক তথ্য আদান-প্রদান সক্ষম করে- যা সবাইকে বিপর্যয় মোকাবিলায় সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে যদি দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং অবকাঠামো-নির্মাণের প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় তাহলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উন্নতির সম্ভাবনা আশাব্যঞ্জক। কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো অপরিহার্য। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়, পরিষেবাগুলি উন্নত করতে অবশ্যই অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা, দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম চালানো এবং পুনর্গঠন করা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া, সঠিক প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধমূূলক ব্যবস্থা গৃহীত হলে, দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাম্প্রতিক উন্নতি লক্ষ্যণীয় হলেও, আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।

তথ্যসূত্র :

১। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন

২। আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন কৌশল সংক্রান্ত গবেষণা ও প্রতিবেদন

মেজর মো. শাহরিয়ার হাসান; পিএসসি : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে