মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তি যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন এর প্রভাব কেবল একটি অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, পুড়িয়ে দেয় মানবিকতার শেষ আশ্রয়স্থলও। 'নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না' প্রবাদটি বর্তমান পৃথিবীর চলমান সংকট ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে যেন। গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল দুইটি ভিন্ন প্রান্তের ঘটনা তবুও যেন মানবিক অবক্ষয়ের একই গল্প সাজানো। গাজা উপত্যকা আজ এক মৃতু্যপুরী। ইসরায়েলের ক্রমাগত আগ্রাসনে এই অঞ্চলের শিশু, নারী এবং বৃদ্ধসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। তথাকথিত 'সেফ জোন'-এর ধারণাটিও এখানে ব্যর্থ হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলের আক্রমণে একটি সেফ জোনে ৪৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে পাঁচজন শিশু। বাস্তুচু্যত ফিলিস্তিনিদের তাঁবুতেও নির্বিচারে বোমা ফেলা হয়েছে। এমনটা কি মানা যায়? জাতিসংঘের পরিসংখ্যান বলছে, এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৪৫ হাজার ৮৮৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে। প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবে কি আমরা ধরে নেব 'বিশ্ব শান্তি', 'বিশ্ব মানবতা' এ জাতীয় শব্দের ব্যবহার শুধুই পাশবিক ছলনার কৌশলী বয়ান মাত্র? এই যে গাজার বর্তমান অবস্থা, তা কি শুধু সেই অঞ্চলের সংকট? আমি মনে করি, এটি বিশ্ব বেহায়া মোড়লদের পাশবিক চিন্তার চর্চা এবং মানবিকতার চরম ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। মসজিদ, স্কুল, হাসপাতাল, এমনকি শরণার্থী শিবিরও ইসরায়েলের নির্বিচার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের আর্তনাদ বিশ্ববাসী শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু তাদের উদ্ধারের জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। শিশুদের নিরাপত্তার জন্য 'সেফ জোন' বানানো হলেও সেখানেও প্রাণঘাতী হামলা চালানো হচ্ছে। এর চেয়ে নির্মম, এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে? অন্যদিকে, লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানলের ঘটনা প্রকৃতির প্রতি মানবজাতির উদাসীনতার আরেকটি করুণ উদাহরণ। প্রথমে মাত্র ২০ একর এলাকা দাবানলে পুড়ে গেলেও তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ১২০০ একর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। দাবানলের ভয়াবহতা স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বাধ্য করেছে। রাতে আগুন আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এই দাবানল শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এটি পরিবেশ দূষণ এবং গেস্নাবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের প্রতিফলন। লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল এবং গাজার ধ্বংসযজ্ঞ, এ দুই ঘটনা দুটি ভিন্ন প্রসঙ্গে ঘটলেও এদের মধ্যে একটি সাধারণ মিল রয়েছে। তা হলো মানবিক মূল্যবোধ এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের প্রতি আমাদের চরম অবহেলা। গাজার ধ্বংসস্তূপে মানুষের জীবন নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। অন্যদিকে, লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রকৃতির ক্রোধ মানুষের লোভের প্রতিফলন। আমরা প্রকৃতিকে যতটা অবজ্ঞা করি, প্রকৃতির প্রতিশোধও ততটাই ভয়াবহ হয়। মানবিকতার এই অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ক্ষমতার রাজনীতি, লোভ এবং উদাসীনতা। গাজার ক্ষেত্রে বিষয়টি স্পষ্টতই রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি নির্মম খেলা। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা এবং তা রোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা বিশ্ববাসীর জন্য লজ্জাজনক। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশগুলো এই আগ্রাসন থামানোর পরিবর্তে উল্টো অস্ত্র সরবরাহ করে ব্যবসা করছে। গাজার শরণার্থীদের করুণ আর্তনাদ আর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপাপড়া মানুষের কষ্টের কথা উপেক্ষা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের জন্য আট বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব করেছেন। এটি কি মানবিকতার চরম ব্যর্থতা নয়? অন্যদিকে, লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল আমাদের পরিবেশগত দায়িত্ববোধের অভাব তুলে ধরছে। বায়ুদূষণ, গেস্নাবাল ওয়ার্মিং এবং বনাঞ্চল উজাড়ের মতো মানবসৃষ্ট সমস্যাগুলোই এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। আমরা যদি পরিবেশের প্রতি সচেতন না হই, তবে লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো দাবানল বিশ্বের সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। আর এসব বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। গাজার এবং লস অ্যাঞ্জেলেসের ঘটনার মধ্যে মানবিকতা এবং পরিবেশের প্রতি উদাসীনতার যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। প্রথমত, গাজার নির্যাতিত মানুষের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থকে পাশকাটিয়ে মানবিকতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের দ্রম্নত পদক্ষেপ নিতে হবে। লোভ এবং ক্ষমতার মোহে পড়ে আমরা যেন নিজেদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস না করি। 'নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না'- এই প্রবাদটি এখন আর সতর্কবার্তা নয়, এটি আমাদের জন্য দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। গাজার শরণার্থীদের আর্তনাদ এবং লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলের ধোঁয়া একই সুরে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, মানবিকতা পুড়লে কেউই রক্ষা পাবে না। তাই আসুন, আমরা একসঙ্গে মানবিক মূল্যবোধ এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করি। আমাদের নির্মোহ চিন্তাভাবনা, ছোট ছোট পদক্ষেপ একদিন একটি সুন্দর পৃথিবী তৈরি করে দেবে। সেই দিনটি আসবে তো? আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও কলামিস্ট