রোববার, ০৪ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

মশার উপদ্রব : কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার প্রতিফলন নেই

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলোতে মশা ও পানিবাহিত রোগব্যাধি ক্রমেই বাড়বে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই স্বাস্থ্যসমস্যা ক্রমেই প্রকট হবে। এ জন্য জাতীয় নীতিকৌশল ঠিক করে সেই স্বাস্থ্যসমস্যা মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। আর ডেঙ্গু যেহেতু নগরের সমস্যা হিসেবে বিবেচিত, তাই নগর কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
আর কে চৌধুরী
  ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মশার উপদ্রব : কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার প্রতিফলন নেই
মশার উপদ্রব : কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার প্রতিফলন নেই

রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে ঢাকায় আছি- স্বাধীনতার আগে রাজধানীবাসীর জন্য প্রবাদ হয়ে উঠেছিল। কালের বিবর্তনে মাছ, মিষ্টি ও ফলমূলে রাসায়নিকের থাবা ঢাকা থেকে মাছির রাজত্বের অবসান ঘটিয়েছে। কিন্তু মশা তার দাপট বজায় রেখেছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষের এই মেগাসিটি মশার কাছে যেন জিম্মি। মশা নিধনে কর্তৃপক্ষের অভাব নেই। প্রতি বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে অঢেল টাকা ব্যয় করছে। তাতে কিছু লোকের পকেট স্ফীতি নিশ্চিত করলেও, মশার উপদ্রব কমছে না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে এডিস মশার আগ্রাসন। ডেঙ্গু নামের ভয়াবহ জ্বরের বিস্তার ঘটায় এ মশা। এডিস মশার আগ্রাসন থাকে বর্ষা মৌসুমে, কিন্তু এখন তা সাংবাৎসরিক মুসিবত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রাজধানীসহ সারাদেশের জনমনে। জ্বর হলেই চিকিৎসকরা পাঠাচ্ছেন পরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এ খাতে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা ভিরমি খাওয়ার মতো। শুরুতে ডেঙ্গু ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক রোগ। মশা নিধনের পদক্ষেপ না নেওয়ায় তা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের ১১টি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়নে মশা নিধন খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৬০ কোটি ২৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এত টাকা ব্যয়ের পরও শুধু রাত নয়, দিনের বেলার স্বস্তিও নষ্ট করছে ক্ষুদ্রকীট মশা। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে রেকর্ডসংখ্যক ১ হাজার ৭০৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। ২০২৪ সালে প্রাণহানির সংখ্যা ৫৭০ জন। মশা নিধনের কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকায় তা দেশবাসীর কোনো কাজে লাগছে না। এডিসের পর এখন চলছে কিউলেক্স মশার আগ্রাসন। মানুষের রাতের ঘুম তো বটেই, দিনের বেলার স্বস্তিও নষ্ট করছে এই মশা। নাগরিকদের সেবা দেওয়া দুই সিটি করপোরেশনের কর্তব্য বলে বিবেচিত। এটি নগরবাসীর প্রতি তাদের দয়াদাক্ষিণ্য নয়। সিটি করপোরেশনের পিয়ন থেকে সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা এ দায়িত্ব পালনের জন্য বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ঘুষ উৎকোচ ছাড়া সিটি কর্তাদের কর্মকান্ডে সদিচ্ছার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া ভার- যা মশাসহ সব নাগরিক সমস্যাকে জিইয়ে রাখছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার অবসান অবশ্যই কাম্য।

মশা নিধনে ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশন প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও তাতে অশ্বডিম্ব প্রসবই শুধু নিশ্চিত হচ্ছে। মশা নিধনে যে ওষুধ ছিটানো হয় তাতে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকায় ট্যাক্সদাতাদের অর্থের শ্রাদ্ধ হলেও মশার হাত থেকে নগরবাসী রক্ষা পাচ্ছেন না। গত ২২ বছরে মশার পেছনে সিটি করপোরেশনের খরচ হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। এ বিশাল অর্থ ব্যয়ের দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো সুফল পাননি নগরবাসী।

আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে দূর অতীতেও ঢাকায় মশার উপদ্রব ছিল। সে সময়ও মশা নিয়ন্ত্রণে নগর কর্তৃপক্ষ কাজ করেছে। সেই কার্যক্রম এখন আরও জোরদার হয়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন মশা নিয়ন্ত্রণে বিপুল অর্থ খরচও হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো সুফল মিলছে না। আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে বাংলাদেশে মশাজাতীয় কীটপতঙ্গের উপদ্রব বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব কীটপতঙ্গের উপদ্রব অনেকাংশে বেড়েছে। তা নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের গবেষণা, কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান, প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তার অনুপস্থিতি সংকট বাড়াচ্ছে।

ফেব্রম্নয়ারি, মার্চ সময়টা কিউলেক্স মশা প্রজননের সময়। মশা জন্মায় পুকুর, ডোবা ও নর্দমায়। দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক ডোবা ও নর্দমার উপস্থিতি থাকায় মশার উপদ্রব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ডোবা, নালা ও নর্দামাগুলো পরিষ্কার না করায় মশার উপদ্রব বাড়ছে। মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ কেনা হয় সেখানে চলে নানা ভাগবাটোয়ারা। এ অবাধ হরিলুট মশার দৌরাত্ম্য বাড়াতে অবদান রাখছে। মশা নিধনে নিতে হবে সমন্বিত পদক্ষেপ। একদিকে, মশা নিধনের ওষুধ ছিটাতে হবে; অন্যদিকে, ডোবা, নালা ও জলাশয় পরিষ্কার রাখতে হবে। মশার হাত থেকে রেহাই পেতে হলে উভয় দায়িত্ব সমভাবে করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের সততাও নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

কীটতত্ত্ববিদ ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশাবাহিত রোগসহ কিছু রোগব্যাধি দ্রম্নত ছড়াচ্ছে। ডেঙ্গু তেমনই একটি রোগ। এডিস মশার জীবাণু বহন করে। তাদের মতে, মৌসুমের শুরুতে যদি এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হতো তাহলে রোগটির বিস্তার এতটা খারাপ পর্যায়ে যেত না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য মশা নিধন অভিযানে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। খুব সামান্য পানিতেই এডিস মশা বংশবিস্তার করতে পারে। সাধারণত পরিষ্কার পানিতেই এই মশা বংশবিস্তার করে। মানুষ যত্রতত্র পলিথিনের ব্যাগ, ডাবের খোসা, বোতল, ক্যান, পরিত্যক্ত টায়ার বা বিভিন্ন ধরনের পাত্র ফেলে রাখে। সেগুলোতে জমা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশা অনায়াসে বংশবিস্তার করতে পারে। ফুলের টবে কিংবা ছোটখাটো পাত্রে পানি জমে থাকলে তাতেও বংশবিস্তার হয়। নির্মীয়মাণ ভবনগুলোতে তো রীতিমতো মশার চাষ করা হয়। আর দুই বাড়ির মধ্যখানে সরু জায়গায় রীতিমতো আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে। অনেক বাড়ির সানসেটেও আবর্জনা জমে থাকতে দেখা যায়। এসব জায়গায় এডিস মশার বংশবিস্তার দ্রম্নততর হয়। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার বংশবিস্তারের সুযোগ নষ্ট করতে হবে। সেই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ মশা ও লার্ভানাশক ওষুধও যথেষ্ট পরিমাণে ছিটাতে হবে। মশার হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে সেসব জায়গায় অভিযান সর্বাধিক জোরদার করতে হবে।

বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলোতে মশা ও পানিবাহিত রোগব্যাধি ক্রমেই বাড়বে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই স্বাস্থ্যসমস্যা ক্রমেই প্রকট হবে। এ জন্য জাতীয় নীতিকৌশল ঠিক করে সেই স্বাস্থ্যসমস্যা মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। আর ডেঙ্গু যেহেতু নগরের সমস্যা হিসেবে বিবেচিত, তাই নগর কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও ড্রেনগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না থাকা মশার বংশবিস্তারের অন্যতম কারণ। সঙ্গতকারণেই সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে যত দ্রম্নত সম্ভব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে কয়েক গুণ। এছাড়া ডেঙ্গুর ছড়াছড়ি চলছে দেশজুড়ে। প্রাণহানী ঘটছে এতে। ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি কোনোভাবই এড়ানোর সুযোগ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, যে কোনো উপায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখনই মশা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে মশার ঘনত্ব বেড়ে চরমে পৌঁছাবে। এমনকি অতীতের ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে- এমন আশংকাও উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়টিকেও সামনে রাখা দরকার। নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিমত, মশা বৃদ্ধির পেছনে আবহাওয়া ও পরিবেশের প্রভাব থাকলেও এটিই একমাত্র কারণ নয়। এর নেপথ্যে আরও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

বিশেষ করে নালা, ডোবা, পুকুর ও পরিত্যক্ত জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার এবং মশা মারার ওষুধ কেনা সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগও উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমে। সেখানে আলোচনায় এসেছে যে, সঠিকভাবে ডোবা, জলাধার পরিষ্কার করা হচ্ছে না। মানহীন মশার ওষুধ কেনার কারণে এই ওষুধে কাজ হয় না। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মশা নিধনকর্মীরা মানহীন ওই ওষুধও নিয়ম মেনে ছিটায় না। বাইরে এসব বিক্রি করে দেয় এমন বিষয়ও খবরের মাধ্যমে উঠে এসেছে- যা সামলে নেওয়া অপরিহার্য। মশা নিধনে শুধু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নয়, স্থায়ী পরিকল্পনা নিতে হবে।

নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নাগরিকদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মশা নিধনে শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন সব পক্ষের সচেতনতা। পরিচ্ছন্নতা, জনসচেতনতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আশংকা এটিকে সামনে রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মশার উপদ্রব রোধে সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সভাপতি বাংলাদেশ ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে