রোববার, ০৪ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়তে হবে

আমরা যখন কুষ্ঠ দিবস পালন করি তখন আমরা এমন একটি বিশ্বের কল্পনা করি- যেখানে কুষ্ঠ একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আর থাকবে না এবং আক্রান্ত ব্যক্তিরা বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারবে।
মো. সাজেদুল ইসলাম
  ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়তে হবে
কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়তে হবে

আজ 'বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস'। কুষ্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আক্রান্তদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা চালানোর এই দিবসটি উলেস্নখযোগ্য উপলক্ষ। প্রতি বছর জানুয়ারির শেষ রোববার বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো- কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রচার করা, সামাজিক বৈষম্যের জন্য অবদান রাখে এমন ভুল ধারণাগুলো দূর করা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ডায়াগনস্টিক, থেরাপিউটিক, পুনর্বাসনমূলক পরিষেবাগুলোর নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা করা, বিশ্বব্যাপী কুষ্ঠ সংক্রান্ত সহযোগিতা জোরদার করা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা উন্নত করতে অর্থ বরাদ্দ করা।

এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'ঐক্যবদ্ধ কাজ করি, কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ি'। প্রতিপাদ্যটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে কুষ্ঠ দূর করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছে।

১৩টি আন্তর্জাতিক কুষ্ঠবিরোধী বেসরকারি সংস্থার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ফেডারেশন 'ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব অ্যান্টি- লেপ্রসি অ্যাসোসিয়েশন (আইলেপ)' এই দিনটি উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ রবিবার দিবসটি পালনের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরবর্তী সময়ে এই উদ্যোগটিকে সমর্থন করে বিশ্বব্যাপী এর প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

আইলেপ হলো আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলোর একটি কনসোর্টিয়াম- যারা কুষ্ঠমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য বিশ্বব্যাপী কাজ করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কুষ্ঠ রোগকে ২০টি অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগের মধ্যে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কুষ্ঠ একটি অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ- যা এখনো ১২০ টিরও বেশি দেশে দেখা যায়, প্রতি বছর ২০০,০০০ এরও বেশি নতুন কেস রিপোর্ট করা হয়।

বাংলাদেশে কুষ্ঠ রোগ একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। এটি বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টির জন্যও দায়ী। মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী হলেও দেশে কুষ্ঠ বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। অবহেলার ফলে কুষ্ঠ রোগীদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং বিবাহের মতো বিষয়গুলো ক্ষেত্রে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে।

ন্যাশনাল লেপ্রসি প্রোগ্রাম (এনএলপি)-এর তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বার্ষিক প্রায় ৩০০০ থেকে ৩৫০০ নতুন কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত করা হলেও প্রকৃত সংখ্যাটি এই সংখ্যার দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সময়মতো ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেক কুষ্ঠ রোগী পঙ্গু হয়ে যায়। তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীদের শনাক্ত করা এবং সারাদেশে তাদের উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা জরুরি।

কুষ্ঠ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগ- যা মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রে দ্বারা সৃষ্ট। এটি প্রাথমিকভাবে ত্বক, পেরিফেরাল স্নায়ু, মিউকোসা এবং চোখকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কুষ্ঠ রোগ প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা না করা হলে স্নায়ুর ক্ষতি, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং গুরুতর অক্ষমতার ঝুঁকি হতে পারে। এতে ব্যক্তি, পরিবার এবং সমগ্র সম্প্রদায়কে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। যদিও রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য, কুসংস্কারের মতো বিষয়গুলোর কারণে প্রায়ই আক্রান্ত ব্যক্তিদের সময়মত চিকিৎসা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

দেখা যায় যে, আক্রান্ত ব্যক্তিরা কুষ্ঠের কারণে বৈষম্য এবং সামাজিকভাবে বর্জনের শিকার হয়। পুরুষ, মহিলা এবং শিশুরা যারা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছে তারা সামাজিক অবিচারের শিকার হয়েছে। ভয় এবং কুষ্ঠরোগের সঙ্গে যুক্ত কুসংস্কারের ফলে তাদের সবচেয়ে মৌলিক মানবাধিকারগুলোকে অস্বীকার করা হয়েছে। কুষ্ঠ নিরাময়যোগ্য রোগ হওয়া সত্ত্বেও পুরনো কিছু স্টেরিওটাইপ এবং আপত্তিকর নাম রয়ে গেছে- যার ফলে, ব্যাপক কুসংস্কার এবং বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।

২০১০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এবং মানবাধিকার কাউন্সিল কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য নীতি ও নির্দেশিকা গ্রহণ করে। এই নীতি ও নির্দেশিকাগুলো কুষ্ঠ সম্পর্কিত বৈষম্য দূর করার জন্য বিশ্বের সরকারগুলোকে দায়বদ্ধ করে।

২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ 'ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক পস্ন্যান ফর লেপ্রসী ২০২৩-৩০' প্রণয়ন করেছে। এখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার দেশের বিভিন্ন খাত সংস্কারে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। তার মধ্যে স্বাস্থ্য একটি খাত। স্বাস্থ্য খাতে কুষ্ঠ রোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও কুষ্ঠরোগ ব্যাপক মানুষের দুর্ভোগের জন্য দায়ী, তবুও এটি দেশে অবহেলিত একটি ইসু্য হিসেবে রয়ে গেছে। স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের উচিত, জাতীয় স্বার্থে কুষ্ঠ রোগের বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া ও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গহণ করা।

আমরা যদি কুষ্ঠ সমস্যাকে সঠিকভাবে সমাধান করতে পারি তবে আমরা জাতীয়ভাবে উপকৃত হতে পারি। তাই, জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দসহ কুষ্ঠরোগ যথাযথ মনোযোগের দাবি রাখে।

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস-এর চেতনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উলেস্নখ্য, এসডিজি ৩ : সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ: কুষ্ঠরোগ নির্মূলের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এই দিনটি সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ও সুস্থতার বার্তা প্রচার করে এবং অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় মহামারি দূর করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।

এসডিজি ১০: বৈষম্য হ্রাসকরণ: এটি সমান চিকিৎসার পক্ষে ওকালতি করতে এবং কুষ্ঠরোগে আক্রান্তদের অসমতা কমাতে বিশেষ করে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রবেশগম্যতা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমরা যখন কুষ্ঠ দিবস পালন করি তখন আমরা এমন একটি বিশ্বের কল্পনা করি- যেখানে কুষ্ঠ একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আর থাকবে না এবং আক্রান্ত ব্যক্তিরা বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারবে।

দিবসটি কুষ্ঠ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত কুসংস্কার দূর করার জন্য সম্মিলিত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এই দিবস পালনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো হলো রোগের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করা; আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা করে এমন নীতিগুলোর পক্ষে সমর্থন করা; সচেতনতা এবং অন্তর্ভুক্তির ধারণা প্রচারের মাধ্যমে সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা; রোগ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মানসিক সুস্থতার বার্তা প্রচার করা।

কুষ্ঠ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী প্রতিশ্রম্নতির একটি শক্তিশালী অনুস্মারক হলো এই বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে একটি কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে। তবে, টেকসই প্রচেষ্টা, নীতি সহায়তা, এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে এই রূপকল্প অর্জনের চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়।

কুসংস্কার মোকাবিলা করে, স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশগম্যতার উন্নতি করে এবং মানসিক সুস্থতার কথা প্রচার করার মাধ্যমে আমরা শুধু জনস্বাস্থো্যর উদ্বেগ হিসেবে চিহ্নিত কুষ্ঠকেই নির্মূল করি না, বরং এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত সমস্ত ব্যক্তির জন্য মর্যাদা এবং সমতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাও আমরা করি।

আসুন আমরা সরকারের অগ্রণী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কুষ্ঠ সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হই।

মো. সাজেদুল ইসলাম : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে