বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

শিক্ষাব্যবস্থায় ক্যারিয়ার গাইডেন্সের অভাব ভবিষ্যৎ কি অনিশ্চিত?

প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হলেও, শিক্ষার্থীদের সেগুলোর প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে, কারণ দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের গতি হারায়।
মোছা. রোকেয়া সুলতানা
  ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শিক্ষাব্যবস্থায় ক্যারিয়ার গাইডেন্সের অভাব ভবিষ্যৎ কি অনিশ্চিত?
শিক্ষাব্যবস্থায় ক্যারিয়ার গাইডেন্সের অভাব ভবিষ্যৎ কি অনিশ্চিত?

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কি শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তবসম্মত কর্মসংস্থানের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে? নাকি এটি কেবল সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়াচ্ছে? পরিসংখ্যান বলছে, দেশের উচ্চশিক্ষিত যুবশ্রেণির মধ্যে বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই ফলাফল কি কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়? বাস্তবতা হলো, দেশে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সার্টিফিকেট অর্জন, যেখানে দক্ষতা, ব্যবহারিক জ্ঞান এবং পেশাগত অভিজ্ঞতার অভাব প্রকট। ২০১৭ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে- যা মূলত সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবের বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৪৭ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি কেবল ডিগ্রি প্রদানের জন্য, নাকি বাস্তবমুখী দক্ষতা উন্নয়নেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে?

বর্তমানে দেশের স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য বা দিকনির্দেশনা ছাড়াই শিক্ষা গ্রহণ করছে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক বা স্নাতক পর্যায়ে এসে বুঝতে পারে যে, তারা কোন পেশার জন্য উপযুক্ত। ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের অভাবে তারা নিজেদের দক্ষতা, কর্মক্ষেত্রের চাহিদা এবং আগ্রহের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে পারছে না। অথচ, উন্নত বিশ্বে স্কুলজীবন থেকেই ক্যারিয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়- যা শিক্ষার্থীদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রযুক্তিনির্ভর চাকরির সুযোগ বাড়লেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী এর জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ, তারা কারিগরি দক্ষতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। বর্তমান চাকরির বাজারে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতা যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স, প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যারিয়ার গাইডেন্সের অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও, সেগুলো মূলত সেমিনার বা ওয়ার্কশপের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোনো দীর্ঘমেয়াদি, কাঠামোবদ্ধ ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সিস্টেম এখনো গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও শিল্প খাতের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগও অত্যন্ত সীমিত- যার ফলে, শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই বললেই চলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন- স্থানীয় শিল্প খাতের সঙ্গে সংযোগের অভাবে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সরকার ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতিতে কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দিলেও, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতি সম্পন্ন। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারিত করার কথা বলা হলেও, তা এখনো মূলধারার শিক্ষার্থীদের কাছে পর্যাপ্তভাবে পৌঁছায়নি। এমনকি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সেবা বাধ্যতামূলক করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্কুল পর্যায় থেকে ক্যারিয়ার গাইডেন্স বাধ্যতামূলক করা, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন পেশাদার ক্যারিয়ার পরামর্শক নিয়োগ নিশ্চিত করা, শিল্প-একাডেমিয়া সংযোগ জোরদার করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইন্টার্নশিপ, শিল্প পরিদর্শন এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো, বাজারের চাহিদাভিত্তিক পাঠ্যক্রম প্রণয়, তথ্যপ্রযুক্তি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং নবায়নযোগ্য খাতের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, অনলাইন পস্ন্যাটফর্ম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনভিত্তিক ক্যারিয়ার পরামর্শ পস্ন্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে।

শিক্ষার্থীরা যদি সঠিক সময়ে ক্যারিয়ার পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা না পায়, তবে তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে এবং অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে অযাচিত পথে ধাবিত হয়। একটি প্রচলিত ধারা হলো- শিক্ষার্থীদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার দিকেই বেশি প্রভাবিত করা হয়। অথচ, বর্তমান বিশ্বে চাকরির বাজার দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হলেও, শিক্ষার্থীদের সেগুলোর প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে, কারণ দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের গতি হারায়।

এখন প্রশ্ন হলো, সরকার ও শিক্ষাবিদরা কবে নাগাদ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের দিকে মনোযোগ দেবে? আমাদের কি নতুন প্রজন্মকে শুধু সার্টিফিকেট নির্ভর করে রেখে দিতে হবে, নাকি বাস্তবমুখী দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে? যদি অবিলম্বে এই বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে বিশাল এক বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে- যা দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

সময় এসেছে শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে ক্যারিয়ার গাইডেন্সকে অন্তর্ভুক্ত করার- যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু পড়াশোনার জন্য পড়াশোনা না করে, বরং দক্ষ হয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে হলে শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী শিক্ষার দিকনির্দেশনা নিশ্চিত করাই একমাত্র পথ।

মোছা. রোকেয়া সুলতানা :শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে