সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

দারিদ্র্যের বেড়াজালে চরাঞ্চলের শিক্ষা

দেশের প্রতিটি অঞ্চলের সমান উন্নয়ন নিশ্চিত করা কেবল ন্যায়সঙ্গতই নয়, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্তও বটে। চরাঞ্চলের মানুষের উন্নতির জন্য প্রয়োজন একটি টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে থাকবে দক্ষ শিক্ষক, পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিটি শিশুরই অধিকার রয়েছে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার, সঠিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার। কিন্তু তা বাস্তবে রূপ দিতে হলে চাই রাষ্ট্রের কার্যকর উদ্যোগ, চাই সামাজিক আন্দোলন।
হাবিব উলস্নাহ রিফাত
  ০৩ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
দারিদ্র্যের বেড়াজালে চরাঞ্চলের শিক্ষা
দারিদ্র্যের বেড়াজালে চরাঞ্চলের শিক্ষা

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনার বুক চিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য চরাঞ্চল- যেন প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা একেকটি বিচ্ছিন্ন ভূখন্ড। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা যেন এক চিরন্তন সংগ্রাম। প্রতিটি ভোর তাদের জন্য নতুন এক লড়াইয়ের সূচনা করে- কখনো বন্যার সঙ্গে, কখনো খরার সঙ্গে, আর কখনো দারিদ্র্যের নির্মম শিকলে বন্দি থেকে দিনযাপনের সঙ্গে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে সংকটটি চরাঞ্চলের মানুষের জীবনকে পিছিয়ে দিয়েছে, তা হলো শিক্ষা ও উন্নয়নের অভাব।

উলেস্নখ্য, শিক্ষা হলো মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় উন্নতির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। কোনো জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে শিক্ষাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু চরাঞ্চলের মানুষ আজও সেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এখানকার শিশুরা যখন খোলা আকাশের নিচে নরম কাদার মাটিতে খেলায় মেতে ওঠে, তখন দেশের অন্য প্রান্তের শিশুরা বইখাতা হাতে নিয়ে বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে নতুন জ্ঞানের সন্ধানে মগ্ন হয়। এখানে বিদ্যালয় গড়ে উঠলেও তা থাকে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে রিক্ত।

তদুপরি, বর্ষাকালে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয় অনেক স্কুল, শুকনো মৌসুমে পথঘাটের দুরবস্থায় বিদ্যালয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য শিক্ষার পথ যেন আরও বন্ধুর। নিরাপত্তাহীনতা, দরিদ্রতা ও সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে অল্প বয়সেই তাদের জীবন থমকে যায় বিবাহের বন্ধনে। ফলে, প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করাই যেন এখানকার মানুষের জন্য এক অলীক স্বপ্ন! যদিও অনেকে হয়তো শিক্ষার আলো ছড়াতে চরাঞ্চলে যান, কিন্তু অবকাঠামোর অভাব, বইখাতার সংকট, আর শিক্ষকদের দীর্ঘস্থায়ী অনুপস্থিতি সেই আলোর পথকেও রুদ্ধ করে দেয়।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও চরাঞ্চলের মানুষের অবস্থা করুণ। কৃষিই এখানকার প্রধান জীবিকা, কিন্তু প্রকৃতির নিষ্ঠুর রোষানলে পড়ে একমাত্র অবলম্বন ফসলের জমি যখন বন্যায় ধুয়ে যায়, তখন দারিদ্র্যের করাল ছায়া আরও গাঢ় হয়। ফলে, অনেকে জীবিকার সন্ধানে শহরে পাড়ি জমায়, কিন্তু শিক্ষার অভাবে সেখানে গিয়েও পড়ে যায় শোষণের দুষ্টচক্রে। অথচ একদিনের জন্যও ভাবা হয় না- শিক্ষাই পারে তাদের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করতে, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনতে।

বলা বাহুল্য, শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ উন্নয়নকে ধারণ করতে পারে না। যখন রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে বহুতল ভবন গড়ে ওঠে, কিংবা উন্নত প্রযুক্তি আর জ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটে, তখন চরাঞ্চলের মানুষ অন্ধকারেই রয়ে যায়। তাদের জন্য নেই আধুনিক চিকিৎসা, নেই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, নেই প্রযুক্তির ছোঁয়া। সরকার ও এনজিওগুলোর কিছু প্রচেষ্টা চোখে পড়লেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। সেতুবন্ধনহীন চরগুলোকে শহরের সঙ্গে সংযুক্ত না করলে সেখানে উন্নয়নের আলো পৌঁছাবে কীভাবে?

অতএব, চরাঞ্চলের দারিদ্র্য এবং শিক্ষার এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বহুমুখী পদক্ষেপ। প্রথমত, চরাঞ্চলের মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে হবে। এজন্য কৃষি, মৎস্য আহরণ, এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। চরের মানুষদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং বাজারজাতকরণের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, চরাঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুলগুলো চরের কাছাকাছি স্থাপন করতে হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে, শিক্ষক ও উপকরণের অভাব দূর করতে হবে। এছাড়া, চরের শিশুদের জন্য বৃত্তি ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে- যাতে তারা স্কুলে যেতে উৎসাহিত হয়। তৃতীয়ত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে হবে। নারী শিক্ষার প্রসারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে, এবং সামাজিক কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা দূর করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

সর্বোপরি, দেশের প্রতিটি অঞ্চলের সমান উন্নয়ন নিশ্চিত করা কেবল ন্যায়সঙ্গতই নয়, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্তও বটে। চরাঞ্চলের মানুষের উন্নতির জন্য প্রয়োজন একটি টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে থাকবে দক্ষ শিক্ষক, পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিটি শিশুরই অধিকার রয়েছে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার, সঠিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার। কিন্তু তা বাস্তবে রূপ দিতে হলে চাই রাষ্ট্রের কার্যকর উদ্যোগ, চাই সামাজিক আন্দোলন। শিক্ষা যে শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়, বরং দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ, উন্নয়নের চাবিকাঠি- এ সত্যটি চরাঞ্চলের প্রতিটি ঘরে পৌঁছানো প্রয়োজন।

হাবিব উলস্নাহ রিফাত : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে