শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

'মব আতঙ্ক' প্রতিরোধে চাই কঠোর পদক্ষেপ

জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। সংবিধানও সে কথাই বলে। কাজেই এক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। 'মব জাস্টিস'সহ সব ধরনের বেআইনি কর্মকান্ড প্রতিরোধ করে সরকার দেশে অচিরেই স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনবে, এটাই কাম্য।
আর কে চৌধুরী
  ০৯ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
'মব আতঙ্ক' প্রতিরোধে চাই কঠোর পদক্ষেপ
'মব আতঙ্ক' প্রতিরোধে চাই কঠোর পদক্ষেপ

গণপিটুনির সহস্রাধিক ঘটনায় গত ১০ বছরে দেশে প্রায় ৮০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এ বছর প্রথম দুই মাসেই ৩০টি ঘটনায় প্রাণ হারায় ১৯ জন। অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাত মাসে গণপিটুনির ১১৪টি ঘটনায় প্রাণ হারায় ১১৯ জন। বর্তমানে বহুল আলোচিত একটা শব্দবন্ধ হচ্ছে 'মব জাস্টিস'। মানে উত্তাল বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার কখনো সুবিচার হতে পারে না। আর এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ কথা সব পর্যায় থেকে সব সময় বলা হয়। তারপরও এ ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। মব জাস্টিস সমাজে এক নতুন আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। এর থাবা থেকে পুলিশও রক্ষা পাচ্ছে না। এ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। তদন্তে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটানো হচ্ছে টার্গেট করে। চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে গণপিটুনি বা গণতলস্নাশির নামে। ব্যক্তি বা দলগত বিদ্বেষ কিংবা পূর্বশত্রম্নতার কারণেও কেউ কেউ জনতাকে উসকে দিয়ে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রতারক চক্র দুদকের নামে বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়ি বা প্রতিষ্ঠান তলস্নাশি চালিয়ে লুটপাট ও অর্থ আদায় করেছে- এমনও হয়েছে। এসব কারণে জনগণ শঙ্কিত। স্বভাবতই সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এখনই এর রাশ টানতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। এ ধরনের অরাজকতাকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। বিশেষজ্ঞের মতে, মূলত পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা এবং অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। এগুলো আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির বহিঃপ্রকাশ। দ্রম্নত পদক্ষেপ নিয়ে এই সর্বনাশা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। পুলিশকে নৈতিক ও পেশাগত দৃঢ়তা নিয়ে স্বমহিমায় ফিরতে হবে। পুলিশ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হবে না। এজন্য তাদের উদ্দীপ্ত করতে হবে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। না হলে এ জঘন্য অপরাধের অরাজকতা এবং তার গস্নানি থেকে মুক্তি নেই।

আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। জুলাই গণ-অভু্যত্থানে দেশের বেশ কয়েকটি কারাগার ভেঙে বেরিয়ে আসে চিহ্নিত অপরাধীরা। থানা ও কারাগার থেকে লুট হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। আইনশৃঙ্খলার জন্য যা ইতোমধ্যে হুমকি সৃষ্টি করেছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে থানাভিত্তিক অপরাধীদের তালিকা হালনাগাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তলস্নাশি চৌকি ও টহল। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের। চিহ্নিত অপরাধী, সন্ত্রাসী, মাদক ও চোরাকারবারিদের ধরতে গত ৮ ফেব্রম্নয়ারি থেকে সারাদেশে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল বাড়ানো ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য 'দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর গুরুত্বসহ আইন প্রয়োগ' বিষয়ে ওয়ার্কশপ হয়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তলস্নাশি চৌকি ও অপরাধপ্রবণ এলাকায় টহল বাড়ানো হয়েছে। টার্গেট এলাকায় জোরদার অভিযান চালাচ্ছে যৌথবাহিনী। নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের অতিরিক্ত প্যাট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছিনতাইকারী, ডাকাত, কিশোর গ্যাংসহ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পতিত সরকারের হুকুম পালন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষের ওপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন, তার বদলা নিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বিপুলসংখ্যক পুলিশ স্থাপনায় হামলা চালায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। পরিণতিতে অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। পতিত সরকারের সহযোগীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে অপরাধী চক্রকে সহায়তা করছে, এমন অভিযোগও রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে অপরাধী যে-ই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা সরকারের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করা যায়, থানাভিত্তিক অপরাধীদের তালিকা তৈরি এবং তলস্নাশি চৌকির সংখ্যা বৃদ্ধি অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখবে।

সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা এক ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে সর্বত্র। এ 'মব জাস্টিসে' কাউকে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে, কারও বাসায় ঢুকে লুটপাট করা হচ্ছে, কোনো থানা ঘেরাও করা হচ্ছে, কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, কাউকে বাধ্য করা হচ্ছে পদত্যাগে। সব মিলিয়ে এক নতুন আতঙ্কের নাম এখন 'মব জাস্টিস'। একটি দেশে বিপস্নব বা বড় কোনো পরিবর্তনের অব্যবহিত পর এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। যেমন, এ দেশে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভু্যত্থান সফল হওয়ার পর সৃষ্ট পরিস্থিতি। তখন বিগত সরকারের ১৫-১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল, তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কিছু বেআইনি কর্মকান্ড ঘটা অস্বাভাবিক ছিল না। অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর মানুষের মনের সেই ক্ষোভ দিনে দিনে কমে আসবে, এটাই সবাই আশা করেছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অভু্যত্থানের ৭ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও 'মব জাস্টিস' বন্ধ হচ্ছে না, বরং দিন দিন তা প্রকট আকার ধারণ করছে। জনমনে বাড়াচ্ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

এটা ঠিক, ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের পর পুলিশের মনোবলে চির ধরেছিল, তারা নিষ্ক্রিয় ছিল বেশ কিছু দিন। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা আবার কর্মস্থলে ফিরে এসেছে। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা। রয়েছে আনসার বাহিনী। এরপরও দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না কেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা মনে করি, দেশে কেউ যাতে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে কঠোরতার প্রমাণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চায় দেশবাসী। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। সংবিধানও সে কথাই বলে। কাজেই এক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। 'মব জাস্টিস'সহ সব ধরনের বেআইনি কর্মকান্ড প্রতিরোধ করে সরকার দেশে অচিরেই স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনবে, এটাই কাম্য।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে