বিগত সময়ে আমরা প্রায়শই সংবাদ শিরোনাম হতে দেখেছি যে, স্থাপনা নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহৃত হচ্ছে। বাহ্যিকভাবে বাঁশের ব্যবহার স্থাপনার সৌন্দর্য বা নান্দনিকতার ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে না ঠিকই, তবে, এটি স্থাপনার ভিত্তিকে অত্যন্ত নড়বড়ে করে ফেলছে। একইভাবে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায়ও রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের অনেকটা মিল পাওয়া যায়। প্রতি বছর, সার্টিফিকেটধারী হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে ঠিকই, তবে তিক্ত বাস্তব চিত্র হলো, অনেকাংশেই এই গ্র্যাজুয়েটরা কর্মদক্ষতাহীন এবং গবেষণার প্রতি অনাগ্রহী। যা বেকারত্বের সংকটকে মহামারির রূপ দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আধুনিক বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কেবল উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং জ্ঞানচর্চা, গবেষণা এবং সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি। হাজার বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই শিক্ষাব্যবস্থা আজ প্রযুক্তি ও ডিজিটাল উদ্ভাবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান অর্জন ও বিস্তার। গবেষণার মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন সম্ভব হয়- যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অগ্রগতির চাবিকাঠি। বিশেষজ্ঞদের মতে, 'শুধু বই পড়ে ডিগ্রি অর্জন নয়, বরং বাস্তব জীবনে দক্ষতা প্রয়োগ করাই উচ্চশিক্ষার আসল উদ্দেশ্য।'
শুধু তা-ই নয়, দক্ষ জনবল তৈরি, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং নেতৃত্ব গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেবল পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি-অভিযোজনমূলক শিক্ষা, স্টার্টআপ ইনকিউবেশন সেন্টার ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতা গড়ে তুলছে।
শিক্ষা ও গবেষণার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং পরিপূরক। শিক্ষা মানুষের চিন্তা, দক্ষতা ও ধারণার বিকাশ ঘটায়- যা পরবর্তী সময়ে গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয় এবং আরও উন্নত করা যায়। অন্যদিকে, গবেষণার ফলাফল শিক্ষার মান উন্নয়নে অবদান রাখে, নতুন পাঠ্যক্রম তৈরি করতে সহায়তা করে এবং শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এই প্রক্রিয়ায়, শিক্ষা ও গবেষণা একে অপরকে সমৃদ্ধ করে এবং সমাজের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।
কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা অনেকাংশেই জ্ঞান অর্জন ও গবেষণার পরিবর্তে লেজুরভিত্তিক রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে- যা তাদের একাডেমিক ও পেশাগত বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ও শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অগ্রগতিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো সমবয়সি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। বারবার আন্দোলন ও অস্থিরতার ফলে সেশনজট দীর্ঘায়িত হচ্ছে, শ্রেণিকক্ষ সংকট প্রকট হয়ে উঠছে এবং গবেষণার সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে- যা শিক্ষার্থীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশেষ করে বাংলাদেশের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান সংকট নিরসনে শিক্ষা এবং গবেষণা এসব সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে :
একাডেমিক মানোন্নয়ন : মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে এবং শিক্ষার্থীরা উন্নত দক্ষতা অর্জন করবে। গবেষণা শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন দৃষ্টিকোণ দিতে সাহায্য করবে- যা তাদের পেশাগত জীবনে সহায়ক হবে।
সেশনজট ও অবকাঠামোগত সংকট সমাধান : শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কার্যকরী নীতি গ্রহণে সহায়তা করা সম্ভব। গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে নতুন পথ দেখাতে পারে, যেমন সেশনজট নিরসন বা অবকাঠামো উন্নয়ন।
উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও সামাজিক উন্নয়ন : গবেষণার মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী সমাধান উদ্ভাবন সম্ভব- যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখবে। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল লার্নিং এবং অনলাইন রিসোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সিস্টেমে বড় পরিবর্তন আনতে পারে- যা শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করবে।
গবেষণা ও দারিদ্র্য বিমোচন : বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যার সমাধান এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব। এতে, দেশের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান আরও ব্যাপক হতে পারে।
সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা ও শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। এটি ভিত্তিহীন আন্দোলন বা অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করবে।
এর পাশাপাশি বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক শিক্ষায় উন্নতি এবং গবেষণায় সুফল বয়ে আনতে পারে নানা দিক থেকে। সুসম্পর্ক শিক্ষার্থীকে একটি নিরাপদ ও সমর্থনমূলক পরিবেশ প্রদান করে, যেখানে তারা নিজেদের মত প্রকাশে উৎসাহিত হয় এবং নতুন ধারণা গ্রহণে আগ্রহী থাকে। এতে শিক্ষকের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা এবং পরামর্শ পাওয়া সহজ হয়- যা তাদের গবেষণার প্রতি আগ্রহ এবং উদ্যোগ বৃদ্ধি করে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সমস্যায় সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকেন। ফলে, তাদের শিখতে এবং গবেষণা করতে গতি এবং দক্ষতা আসে। উপরন্তু, একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে নতুন আইডিয়া শেয়ার এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়- যা গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে সহায়তা করে। দেশের টেকসই উন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে শিক্ষা ও গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গবেষণামুখী শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি- যা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও সমাধান বিকাশে সহায়তা করবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। এর পাশাপাশি, এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে- যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করবে।
বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার সাফল্যের উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঅজও) যৌথভাবে অনেক গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছে- যার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো 'বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত'। এই জাতের উদ্ভাবন কৃষকদের জন্য অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করেছে- যা বাংলাদেশের ধান উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা দেশের টেকসই উন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে আবশ্যক। শিক্ষা নতুন ধারণা ও দক্ষতা প্রদান করে- যা পেশাগত জীবনে সহায়ক। গবেষণা উদ্ভাবন ও সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে- যা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে। সেশনজট ও অবকাঠামোগত সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানসম্মত শিক্ষা এবং গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। তাই, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণা উন্নয়ন দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং চিন্তাভাবনা এবং দর্শনকে ফুটিয়ে তোলে, আর বিশ্বমানের অর্থনীতি, জীবনযাত্রার মান ও সমৃদ্ধিতে শিক্ষা ও গবেষণা একান্ত অপরিহার্য।
রাশেদুল ইসলাম সম্রাট : শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়