বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

জাতীয় স্মৃতিসৌধ

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ১৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
জাতীয় স্মৃতিসৌধ

জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা ও বেসামরিক বাঙালি ও অবাঙালিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্থাপনা। এটি সাভারে অবস্থিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়।

ঢাকা থেকে ৩৫ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে সাভারে এটি অবস্থিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য ত্যাগ ও শৌর্যের স্মৃতি হিসেবে সৌধটি দাঁড়িয়ে আছে।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপনের জন্য এ স্থানটি নির্বাচনের অন্যতম কারণ, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে অনেক গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল।

১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৭৮ সালে সৌধ নির্মাণের উদ্দেশ্যে নকশার জন্য একটি জাতীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সাতান্নজন প্রতিযোগীর মধ্য থেকে স্থপতি মঈনুল হোসেনের নকশাটি নির্বাচিত হয়। ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে সৌধের নির্মাণকাজ শেষ হয়।

স্মৃতিসৌধে সাতটি স্তম্ভ আছে যা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রধান সাতটি আন্দোলনের নিদর্শন বহন করে। এখানে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের দশটি গণকবর রয়েছে। অসমান উচ্চতা ও স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর সাতটি ত্রিভুজাকৃতির প্রাচীর নিয়ে মূল সৌধটি গঠিত। সর্বোচ্চ স্তম্ভটি সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যের ভিত্তির ওপর, আর সর্বদীর্ঘ ভিত্তির ওপর স্থাপিত স্তম্ভটি সবচেয়ে কম উচ্চতার। প্রাচীরগুলো মাঝখানে একটি ভাঁজ দ্বারা কোণাকৃতির এবং একটির পর একটি সারিবদ্ধভাবে বসানো। কাঠামোটির সর্বোচ্চ বিন্দু বা শীর্ষ ৪৫.৭২ মিটার উঁচু। কাঠামোটি এমনভাবে বিন্যস্ত যে, ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে একে ভিন্ন ভিন্ন অবকাঠামোয় পরিদৃষ্ট হয়।

স্থপতি মূল স্তম্ভটি নির্মাণে সিমেন্ট-পাথরের কংক্রিট ব্যবহার করলেও এর সংলগ্ন অন্যান্য অবকাঠোমো ও পেভমেন্ট নির্মাণে লাল ইট ব্যবহার করেছেন। ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের ব্যবহার মূল স্তম্ভটির গাম্ভীর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সমগ্র কমপেস্নক্সটি ৩৪ হেক্টর (৮৪ একর) জমিজুড়ে বিস্তৃত। একে ঘিরে আছে আরও ১০ হেক্টর (২৪.৭ একর) সবুজ ভূমি। স্তম্ভটির সামনে বেশ কয়েকটি গণকবর ও একটি প্রতিফলন সৃষ্টিকারী জলাশয় নির্মিত হয়েছে। প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ করলে স্তম্ভটিকে প্রবেশদ্বারের অক্ষ বরাবরই চোখে পড়ে। কিন্তু মূল বেদিতে পৌঁছতে হলে বেশ কিছু উঁচু নিচু এলাকা, পেভমেন্ট ও একটি কৃত্রিম লেকের ওপর নির্মিত সেতু পার হতে হয় এ সব কিছুই স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামকে চিহ্নিত করছে।

প্রকল্পটি তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম পর্যায় শুরু হয় ১৯৭২ সালে। ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এ পর্যায়টিতে ভূমি সংগ্রহ ও প্রকল্পের রাস্তা নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৪-১৯৮২ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে গণকবর, হেলিপ্যাড, পার্কিংয়ের জায়গা, পেভমেন্ট প্রভৃতি নির্মাণে ব্যয় হয় তিন কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ১৯৮২ সালের আগস্টে সম্পন্ন তৃতীয় পর্যায়ে কৃত্রিম লেক, পাশের সবুজ অঙ্গন, ক্যাফেটারিয়া, হাউজিং প্রভৃতি ছাড়াও মূল স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ব্যয় হয় ৮৪৮.৬৫ লাখ টাকা। নির্মাণ তত্ত্বাবধান করেছে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ।

এছাড়া আরও রয়েছে প্রশস্ত প্রবেশ পথ, পথের দুপাশে নানা জাতের ফুলগাছ, কৃত্রিম জলাশয়, উন্মুক্ত মঞ্চ, সেতু, ফুলের বাগান, অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও হেলিপ্যাড, মসজিদ, রেস্তোরাঁ। নানা জাতের ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছের সমাহার রয়েছে এই কমপেস্নক্সে। অধিগ্রহণকৃত ৮৪ একর জমির মধ্যে প্রায় ৬৪ একর জুড়েই রয়েছে সবুজ বনভূমি। ৪০ একর জায়গায় গড়ে উঠেছে স্মৃতিসৌধ। কংক্রিট নির্মিত স্তম্ভগুলো শুধু স্মৃতিসৌধ নয়। এর মাধ্যমে জাতির মুক্তির সাতটি পর্যায়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পরিক্রমাকে স্মরণ রাখতে সাতটি ঘটনাকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

এই স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্মরণে নিবেদিত এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্মৃতিস্তম্ভ এবং এর প্রাঙ্গণের আয়তন ৩৪ হেক্টর (৮৪ একর)। এ ছাড়াও রয়েছে একে পরিবেষ্টনকারী আরও ১০ হেক্টর (২৪ একর) এলাকা নিয়ে বৃক্ষরাজি পরিপূর্ণ একটি সবুজ বলয়। এই স্মৃতিসৌধ সকল দেশ প্রেমিক নাগরিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় ও সাফল্যের যুগলবন্দি রচনা করেছে। সাতটি ত্রিভুজাকৃতি মিনারের শিখর দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি পর্যায়ের প্রতিটি এক ভাবব্যঞ্জনাতে প্রবাহিত হচ্ছে। মিনারটি ৪৫ মিটার (১৫০.০০ ফুট) উঁচু এবং জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিন্দুতে অবস্থিত। মিনার ঘিরে আছে কৃত্রিম হ্রদ এবং বাগান। স্মৃতিসৌধ চত্বরে আছে মাতৃভূমির জন্য আত্মোৎসর্গকারী অজ্ঞাত শহীদের দশটি গণসমাধি। সৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল নিয়ে গঠিত। দেয়ালগুলো ছোট থেকে ক্রমে বড়ক্রমে সাজানো হয়েছে। এই সাত জোড়া দেয়াল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভু্যত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ- এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করে সৌধটি নির্মিত হয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রনায়করা সরকারিভাবে বাংলাদেশ সফরে আগমন করলে এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন রাষ্ট্রাচারের অন্তর্ভুক্ত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে