আজকের যায়যায়দিন

শহীদ মিনার ভাষা শহীদদের উদ্দেশে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ বলতে এমন এক ধরনের কাঠামোকে বুঝানো হয়ে থাকে, যা শৈল্পিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক কারণে আত্মউৎসর্গকৃত ব্যক্তিদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়। তবে উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে শহীদ মিনার বলতে যারা বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদ (আত্মত্যাগ) হয়েছেন, তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে যা নির্মাণ করা হয়েছে সেই স্থাপনাগুলোকে বুঝায়।

১৯৫২ সালের একুশে ফ্রেব্রম্নয়ারির ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একটি স্তম্ভ নির্মিত হয়, যা বর্তমানে 'শহীদ মিনার' নামে পরিচিত।

শহীদ মিনার ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। ঢাকার কেন্দ্রস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহিঃপ্রাঙ্গণে এটি অবস্থিত। প্রতি বছর ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে এখানে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে।

শহীদ মিনার প্রথম নির্মিত হয় ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি। এর পরিকল্পনা, স্থান নির্বাচন ও নির্মাণকাজ সবই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে সম্পন্ন হয়। বর্তমান শহীদ মিনারের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে শহীদদের রক্তভেজা স্থানে সাড়ে ১০ ফুট উঁচু এবং ৬ ফুট চওড়া ভিত্তির ওপর ছোট স্থাপত্যটির নির্মাণকাজ শেষ হলে এর গায়ে 'শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ' লেখা একটি ফলক লাগিয়ে দেওয়া হয়। নির্মাণের পরপরই এটি শহরবাসীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে; প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রতীকী মর্যাদা লাভ করে। এখানে দলে দলে মানুষ এসে ভিড় জমায়। দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ২৬ ফেব্রম্নয়ারি সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ওই দিনই বিকালে পুলিশ হোস্টেল ঘেরাও করে এটি ভেঙে ফেলে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য / ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল

শহীদ মিনারটি এভাবে ভেঙে ফেললেও পাকিস্তানি শাসকরা শহীদের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেনি। সারাদেশে, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অনুরূপ ছোট ছোট অসংখ্য শহীদ মিনার গড়ে ওঠে এবং ১৯৫৩ সাল থেকে দেশের ছাত্র-যুবসমাজ একুশে ফেব্রম্নয়ারির দিনটিকে 'শহীদ দিবস' হিসেবে পালন করতে থাকে। মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনারের শূন্য স্থানটিতে লাল কাগজে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের অবিকল প্রতিকৃতি স্থাপন করে তা কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সেই প্রতীকী শহীদ মিনার থেকেই সে বছর ছাত্রদের প্রথম প্রভাত ফেরি শুরু হয়। পরের বছরও ছাত্ররা একইভাবে শহীদ দিবস পালন করেন।

১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে ৯ মে-র অধিবেশনে একুশ দফার প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী শহীদ মিনার তৈরি, একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু ওই বছর ৩০ মে ক্ষমতাচু্যত হওয়ায় তা আইনসিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।

১৯৫৬ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি দ্বিতীয়বার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। সে সময়ই একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র স্বঃস্ফূর্তভাবে একুশে ফেব্রম্নয়ারি পালিত হয়। এর ফলেই শহীদ মিনারের নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা সহজতর

হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মিনারের স্থপতি। তারই রূপকল্পনায় ছিল স্নেহময়ী আনত মস্তক মাতার প্রতীক হিসেবে মধ্যস্থলে সুউচ্চ কাঠামো এবং দুই পাশে সন্তানের প্রতীক স্বরূপ হ্রস্বতর দুটি করে কাঠামো। সামনে বাঁধানো চত্বর। পেছনভাবে দেয়ালচিত্র। সম্মুখ চত্বরে ভাস্কর নভেরা আহমেদের দুটি মু্যরাল স্থাপনের পরিকল্পনাও ছিল। এ ছাড়া ছিল বেদনাঘন শহীদ দিবসের প্রতীক হিসেবে একটি ফোয়ারা স্থাপনের পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা মফিক ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ নকশায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সম্মুখভাগের বিস্তৃত এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে দ্রম্নত কাজ সমাপ্তির উদ্দেশ্যে মূল নকশার সরলীকরণ করা হয়।

স্বাধীনতার পর থেকেই প্রবাসীদের উদ্যোগে বিদেশের মাটিতে শহীদ মিনার নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে শহীদ মিনার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার প্রতীকস্বরূপ হয়ে ওঠে। বহির্বিশ্বে ১৯৯৭ সালে প্রথম যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গের ওল্ডহ্যামে এবং ১৯৯৯ সালে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে শহীদ মিনার নির্মিত হয়। তা ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০০৫ সালে জাপানের টোকিওতে শহীদ মিনার নির্মিত হয়। জাপান বাংলাদেশ সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে প্রতিবছর বৈশাখি মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার সূত্র ধরে বাংলাদেশ সরকার এই শহীদ মিনারটি নির্মাণ করে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইতালীসহ বেশ কয়েকটি দেশে শহীদ মিনার নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে।