মির্জা শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ খুররাম 'শাহ জাহান' নামে অধিক পরিচিত। তিনি ১৫৯২ সালের ৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে তিনি ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছেন। শাহ জাহান নামটি এসেছে ফার্সি ভাষা থেকে যার অর্থ 'পৃথিবীর রাজা'। তিনি ছিলেন বাবর, হুমায়ুন, আকবর এবং জাহাঙ্গীরের পরে পঞ্চম মুঘল সম্রাট। ১৬৫৮ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে বন্দি করেন এবং বন্দি অবস্থায় ১৬৬৬ সালে আগ্রা দুর্গে তার মৃতু্য হয়।
তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং তার হিন্দু রাজপুত স্ত্রী তাজ বিবি বিলকিস মাকানির সন্তান। সিংহাসন আরোহণের পূর্বপর্যন্ত শাহাজাদা খুররাম নামে পরিচিত ছিলেন। ১৬২৭ সালে পিতা জাহাঙ্গীরের মৃতু্যর পর তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরের মৃতু্যর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রশ্নে তাঁর জীবিত দুই পুত্র শাহজাহান ও শাহরিয়ারের মধ্যে এক দ্বন্দ্ব সংঘটিত হয়। শ্বশুর আসফ খানের কূটনৈতিক কৌশলের বদৌলতে ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে 'আবুল মুজাফফর শিহাবুদ্দীন মুহম্মদ শাহজাহান' উপাধি নিয়ে শাহজাহান আগ্রার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি উত্তর পূর্বে আসাম ও আরাকানে রাজ্যবিস্তার নীতি অনুসরণ করেন। তিনি কাসিম খান জুইনি (১৬২৮-১৬৩২), আজম খান (১৬৩২-৩৫), ইসলাম খান মাশহাদী (১৬৩৫-১৬৩৯) এবং শাহ সুজাকে (১৬৩৯-১৬৬০) পরপর বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করেন।
তার শাসনামলে মুঘলরা স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক গৌরবের শিখরে পৌঁছেছিল। দাদা আকবরের মতো তিনিও তার সাম্রাজ্য প্রসারিত করতে আগ্রহী ছিলেন।
তার রাজত্বের সময়কালের মুঘল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ ছিল। সম্রাট শাহ জাহান লাল কেলস্না, শাহজাহান মসজিদ এবং তার স্ত্রীর সমাধিসৌধ তাজমহলসহ অনেক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। শাহ জাহান মেওয়ারের রাজপুত ও দাক্ষিণাত্যের লোদিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেন। ১৬২৭ সালের অক্টোবরে জাহাঙ্গীরের মৃতু্যর পর শাহজাহান তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা শাহরিয়ার মির্জাকে পরাজিত করে আগ্রার কেলস্নায় নিজেকে পরবর্তী মুঘল সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেন। শাহরিয়ার ছাড়াও, শাহজাহান সিংহাসনের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দাবিদারকে মৃতু্যদন্ড দিয়েছিলেন।
শাহজাহান দাক্ষিণাত্য সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। তিনি পর্তুগিজ এবং সাফাভিদের সাথে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। সভাপতিত্ব করেন, যখন উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখেন। শাহজাহান মেবারের বিদ্রোহী রাজা রানা অমর সিং কে পরাজিত করেন ও মুঘলদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। তিনি দাক্ষিণাত্যের লোদীদের দমন করেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যর সীমা ঠিক রাখতে পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরকে সাহায্য করেন। জাহাঙ্গীর তার ওপর যারপরনাই খুশি হন। তাকে পরবর্তী সম্রাট ঘোষণা করেন এবং শাহজাদা খুররমকে 'শাহজাহান' বা 'পৃথিবীর সম্রাট' উপাধি দিয়ে দরবারের স্থায়ী সভ্য করে নেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এতে করে মহলের লোকেরা কেউ তাকে হিংসা করতে লাগল, কেউ তাকে তোষামোদ করতে লাগল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কেউই তাকে ভালোবাসত না।
শাহজাহান ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই আসফ খানের জামাতা। তার ছোটভাই শাহজাদা শাহরিয়ার ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের জামাতা,(শের আফগানের কন্যার স্বামী)। শাহজাহান সন্দেহপ্রবণ ছিলেন যে তার অনুপস্থিতিতে শাহরিয়ারকে নূরজাহান সিংহাসনে বসাবেন। তাই সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন অসুস্থ তখন তিনি পিতা ও ভাইদের এবং সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তিনি যুদ্ধে জয়ী হলেও, এসময় কান্দাহার পারস্যের নিকট মুঘলদের হাতছাড়া হয়।
১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে শাহরিয়ার মিরজার পদত্যাগের পর তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন?
শাহজাহানের সময় মুঘল বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দশ লাখে উন্নীত হয়। এবং একে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত করে। তাজমহল, লাল কেলস্না, দিলিস্নর শাহজাহানাবাদ শহর (পুরান দিলিস্ন) প্রভৃতি নির্মাণশৈলীর কারণে তাঁকে 'প্রিন্স অব বিল্ডার্স' বলা হয়ে থাকে। শাহজাহানের শাসনকালে ভারত বিশ্বের ২৪% জিডিপির যোগান দিত। এবং সমসাময়িক বিশ্বে মুঘল ভারত ছিল সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ। তথাপি ১৬৩০ সালে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ ও খরার কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ওইসময়ে শাহজাহান 'লঙ্গর' নামে একধরনের 'মেকশিফট কিচেন' হাজার হাজার স্থাপন করে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করেন। এরকম মেকশিফট কিচেন/লঙ্গরখানার চল এখনও আধুনিক ভারতবর্ষে রয়েছে।
শাহজাহান শিল্পকলার দারুণ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি পৃথিবীর স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ সমাধিসৌধ 'আগ্রার তাজমহল' নির্মাণ করেন। সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ও বিলাসবহুল শাহজাহানাবাদ শহর নির্মাণ করেন দিলিস্নর বুকে। লাল কেলস্না তৈরি করেন বর্তমানে যেখান থেকে প্রতিবছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রজাতন্ত্র দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।
শাহজাহানের শেষ জীবন সুখের ছিল না। তিনি তার জীবনের শেষ বিশ বছর আগ্রা দুর্গে পুত্র আওরঙ্গজেব কর্তৃক গৃহবন্দি হয়ে কাটান। তার জীবদ্দশায় আওরঙ্গজেব তার অবশিষ্ট পুত্র ও তাঁদের ঘরের নাতিদের হত্যা করেন। সম্রাট শাহজাহান অত্যন্ত শিল্পানুরাগী ছিলেন। তাজমহল ছাড়াও তার অমর কীর্তি গুলো হচ্ছে :-
জামা মসজিদ, দিলিস্ন, ভারত
শাহজাহান মসজিদ, সিন্ধু, পাকিস্তান মতি মসজিদ, লাহোর, পাকিস্তান
শালিমার গার্ডেন, লাহোর, পাকিস্তান ওয়াজির খান মসজিদ, লাহোর, পাকিস্তান
দেওয়ান-ই-আম দেওয়ান-ই-খাস ময়ূর সিংহাসন
শাহজাহানের অবদান স্থাপত্যশিল্পে অনস্বীকার্য। তবে এসব স্থাপত্যশৈলি নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করার সময় তিনি শাহী খাজনার দরজা খুলে দিতেন যেন কারিগররা ইচ্ছামতো মজুরি নিতে পারে। ফলস্বরূপ ১৬৬৫ সাল নাগাদ মুঘল শাহী খাজনা প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। শাহজাহানের এই খামখেয়ালিপনাকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূচক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইতিহাসবিদরা।
শাহ জাহান স্বর্ণ (মোহর), রৌপ্য (রুপি) এবং তামা (দাম), এই তিন ধাতুর মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। সিংহাসন আরোহণের পূর্বে প্রচলিত মুদ্রায় তার নাম খুররাম উলেস্নখ করা ছিল।
শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে উত্তরাধিকার প্রশ্নে তাঁর চার পুত্র এক গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এদের মধ্যে সুজাই সর্বপ্রথম নিজেকে রাজমহল থেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। উত্তরাধিকারের এ লড়াইয়ে সুজা দুবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন প্রথমবার দারা এবং দ্বিতীয়বার আওরঙ্গজেব-এর বিরুদ্ধে। বাহাদুরপুরের যুদ্ধে দারার বাহিনী কর্তৃক সুজা পরাজিত হয়ে রাজমহলে প্রত্যাবর্তন করেন। ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব মুরাদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কয়েকটি যুদ্ধে পরপর জয়লাভ করেন। তিনি সম্রাট শাহজাহানকে আগ্রার দুর্গে অন্তরীণ করেন, গোয়ালিয়র দুর্গে মুরাদকে অবরুদ্ধ করে নিজে দিলিস্নর সিংহাসন অধিকার করেন। আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণের পর সুজা পুনরায় তাঁর ভাগ্য পরীক্ষার চেষ্টা করলেও খাজোয়ার যুদ্ধে তিনি দারুণভাবে পরাজিত হন। রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর ক্রমাগত চাপের মুখে সুজা আরাকানে আশ্রয় নেন এবং সেখানকার রাজার গোপন চক্রান্তে সপরিবারে নিহত হন।
আওরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণের আট বছর পর ১৬৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি শাহজাহানের মৃতু্য হয়।