দেশজুড়ে বর্তমান প্রচলিত কোটাবিরোধী স্স্নোগানে উত্তাল। সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বিক্ষোভ উত্তপ্ত লাভাস্রোতের মতো বইছে রাজপথে। সেই উত্তপ্ত লাভাস্রোতে অচল হয়ে পড়েছে সড়ক ও জনপদ। এমনই বেনজীর কান্ড দেখল গতকালের বাংলাদেশ। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাপ বেশ কয়দিন ধরেই চলছিল। আর গতকাল যেন সেটা উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। ১৯৭১-এর পর এমন নজীর দেখেনি বাংলাদেশ। যেটা গতকাল দেখা গেল। তবে এবারের আন্দোলন একেবারে অরাজনৈতিক। তারপরেও অরাজনৈতিক সত্ত্বেও এই ঘটনায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে আহত ও নিহত হয়েছেন বেশ কজন শিক্ষার্থী। গত কয়েকদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে শোবিজ অঙ্গনের তারকারাও নিজেদের ভাবনার কথা জানিয়েছেন। তারাও এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। জানিছেন তাদের বিবেক উন্মোচিত কথা। পাশাপাশি কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন শোবিজ তারকারাও। এই বিক্ষোভ ও বিক্ষোভে নিহত ছাত্রদের নিয়ে চিত্রতারকাদের খোলাখুলি কথাগুলো নিয়ে ফিচার সাজিয়েছেন মাতিয়ার রাফায়েল-
শাকিব খান
এই ঘটনায় অন্যদের মতো শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলায় প্রতিবাদে মুখ খুলেছেন দেশসেরা চিত্রনায়ক শাকিব খানও। এ বিষয়ে বুধবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। পোস্টের ক্যাপশনে শাকিব লিখেছেন, 'আমার প্রাণের বাংলাদেশ এভাবে রক্তে রঞ্জিত হতে পারে না। কারও মা-বাবার বুক এভাবে খালি হতে পারে না। আপনারা যারা অভিভাবক পর্যায়ে আছেন, তাদের কাছে অনুরোধ রইল তারা এর শান্তিপূর্ণ সমাধানে এগিয়ে আসুন। এখনই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এই সংকটের যৌক্তিক সমাধান বের করুন। আমি সব ধরনের সংঘাতের সমাপ্তি চাই।'
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় বিচলিত হয়েছেন দেশের বিশিষ্ট সিনেমা নিমার্তা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও।
মোস্তাফা সরয়ার এই ছাত্রবিক্ষোভের ওপর গুলি চালনাকে শুধু নিন্দাই জানাননি তিনি এই আন্দোলনকে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বুধবার দুপুরে লিখেছেন, আপনারা যারা ভাবছেন আন্দোলনটা স্রেফ একটা চাকরির জন্য, তারা বোকার স্বর্গে আছেন। আপনারা এর সবগুলা স্স্নোগান খেয়াল করেন। দেখবেন, এই আন্দোলন নাগরিকের সমমর্যাদার জন্য। এই আন্দোলন নিজের দেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে না বাঁচার জন্য।
ফারুকী আরও লিখেছেন, এই আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন তাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, দেশের মালিক তারা না। আসল মালিক জনগণ। সেই জনগণকে রাষ্ট্র যে পাত্তা দেয় না, এই আন্দোলন সেটার বিরুদ্ধেও একটা বার্তা। রাষ্ট্র জনগণকে কেন পাত্তা দেয় না এই আন্দোলনকারীরা সেটাও বোঝে। যে কারণে ভোটের বিষয়টাও স্স্নোগান আকারে শুনেছি। আমি এটাকে এইভাবেই পাঠ করছি।
এই নির্মাতা আরও স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, পাবলিক সারভেন্ট শব্দটা বেশ ভালো। নির্বাচিত (!) প্রতিনিধি বা যে কোনো সরকারি বেতনভুক্ত ব্যক্তিকে এই শব্দেই ডাকা উচিত সবসময়। এই আন্দোলন সেই পাবলিক সারভেন্টদের মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, আপনি আমার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। অল পাওয়ার টু দ্য পিপল। অল পাওয়ার টু দ্য ইয়ুথ। প্রেয়ারস ফর মাই ফেলো সিটিজেনস। শহীদের রক্ত কখনো বিফলে যায় না।
স্ট্যাটাসের ফুটনোটে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লিখেছেন, ব্যক্তিগত কৈফিয়ত! এই যে এত লম্বা লেখাটা লিখলাম, এটা আসলে আমি লিখিনি। আমি মুখে বলেছি, একজন ট্রান্সক্রাইব করে দিয়েছে। যারা আমার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানেন, তারা জানেন যে, আমি শারীরিকভাবে এখনো পুরোপুরি সুস্থ না! ফলে আমার সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার সীমিত।
'থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার'খ্যাত এই নির্মাতা আরও লিখেছেন, কোটা আন্দোলন নিয়ে আমি কিছুদিন আগে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে সরিয়ে ফেলেছি। কারণ, একটা স্ট্যাটাস দিলে আমার মাথার মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়! পরবর্তীতে আরেকটা কথা লিখতে ইচ্ছা হয় এবং লিখতে থাকলে যত বেশি এংগেজড হই সেটা আমার শারীরিক অবস্থার জন্য ভালো না। আমার শরীর সুস্থ করার জন্য যে লড়াইটা, সেটা এক দীর্ঘ লড়াই। সেই লড়াইটা করার অনুমতি নিশ্চয়ই পেতে পারি?
আক্ষেপ নিয়ে তিনি লিখেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমার স্ট্যাটাসটা সরিয়ে ফেলার পর থেকে আজকে পর্যন্ত বিভিন্ন অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে লিখেছেন যে, আমি দালাল হয়ে গেছি এই কারণে চুপ হয়ে আছি। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার বিপদ হচ্ছে আপনাকে প্রতিদিন প্রমাণ করতে হবে আপনি কে! আজকে রাষ্ট্র যে অবস্থায় এসেছে এ অবস্থায় আসার শুরু যখন হয়েছিল তখন থেকে তারা যদি আমার ফেসবুকের লেখাগুলো একটু গবেষণা করে দেখত। তাহলে বুঝতে পারত আমি কে, আমি কি বলেছি এবং কি বলার কারণে আমি বারবার বিপদে পড়ি! কোনো রিসার্চ নাই, জাস্ট ঢালাওভাবে দালাল বলে দাও।
শাহবাগ আন্দোলনের ঘটনা স্মরণ করে 'শনিবার বিকেল'র এই নির্মাতা আরও লিখেছেন, আজকে যে বাইনারি চলছে, হয় তুমি আমার পক্ষে না হয় তুমি আমার বিপক্ষে। এই বাইনারির বিপক্ষে আমি ২০১৪ সালে একটা লেখা লিখেছিলাম 'কিন্তু এবং যদির খোঁজে' বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে ওই সময় ছিল শাহবাগের সময়। ২০১৩-তে যখন শাহবাগে আন্দোলন শুরু হলো তখন, বাইনারি এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যে বলতে শুরু হলো 'কিন্তু এবং যদি' যে বলবে সেই রাজাকার। সেই ছাগু। সেই ছাগু ট্যাগটাকে আমি গলার মালা হিসেবে নিয়ে আমি লিখেছিলাম 'কিন্তু এবং যদির খোঁজে'। সবশেষে ফারুকী লিখেছেন, কিছুদিন আগেও আমি বলেছি, স্বাধীনতাকে প্রশ্ন করতে পারাটাই স্বাধীনতা!
চঞ্চল চৌধুরী
ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে শোবিজ অঙ্গনের তারকাদের মধ্যে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী একজন বিবেকবান নাগরিকের মতো সবচে বেশি পরিষ্কার ও জোরালো ভাষায় মুখ খুলেছেন। যে ভাষায় কোনো রাজনীতির গন্ধমাত্র নেই। একেবারেই সাধারণ মানুষের মতো তিনি তার বক্তব্যের প্রথম প্রশ্নটিই ছুঁড়ে দিয়েছেন এইভাবে : এই ছাত্রবিক্ষোভে পুলিশকে গুলি কেন করতে হবে? দেশের চলমান রক্তাক্ত সময়ে দাঁড়িয়ে এই অভিনেতা স্পষ্ট ও জোরালো কণ্ঠে প্রশ্ন তুললেন কর্তৃপক্ষের প্রতি, 'গুলি কেন করতে হলো?' বিশেষ করে তিনি রংপুরে পুলিশের প্রকাশ্য গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের (২২) নিহত হওয়ার ঘটনা তাকে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত করেছে। তাই 'গুলি কেন করতে হলো' বলে প্রশ্নটি তুলেছেন। এই গুলির সন্ত্রাসে সাঈদসহ এই আন্দোলনে ৬ জনের মৃতু্যর খবর মিলেছে।
পেশাগত কারণে গত ২০ দিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। ১৬ জুলাই দিনগত রাতে দেশে ফিরেছেন তিনি। ১৭ জুলাই দুপুর নাগাদ তিনি চলমান সহিংসতা ও হত্যা নিয়ে কথা বলেন। প্রশ্ন তোলেন বেশ কিছু। চঞ্চল বলেন, 'পেশাগত কাজে প্রায় বিশ দিন আমেরিকা থাকার পর গতকাল রাতে ঢাকায় ফিরেছি। সেখানে বসে এই কয়দিন নিউজগুলো দেখে হতবাক হয়েছি। হয়েছি প্রচন্ড শোকাহত! সমাধানের অন্য কোনো পথ কি খোলা ছিল না? গুলি কেন করতে হলো? বুকের রক্ত না ঝরিয়ে সুষ্ঠু সমাধান করা যেত না? যা ঘটে গেল এটা যেমন মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়, বিষয়টা তেমনি হৃদয়বিদারক, মর্মান্তিক এবং সভ্যতা বহির্ভূত এক বর্বর হত্যাকান্ড! আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ এবং অভিভাবক হিসেবে রাজনীতির এত এত কঠিন কৌশল বুঝি না! শুধু একটা প্রশ্ন বুঝি তরুণ তাজা যে প্রাণগুলো অকালে ঝরে গেল, তার দায় কে নেবে? যে মায়ের বুক খালি হলো, তার আর্তনাদ কি কোনো জনমে শেষ হবে? হায়রে দুর্ভাগা দেশ! নোংরা রাজনীতির নামে এই রক্তপাত বন্ধ হোক।' চলমান সহিংসতা নিয়ে চঞ্চলের মতো এর চেয়ে স্পষ্ট ভাষায় এতগুলো প্রশ্ন তুলতে অন্য কোনো শিল্পীকে এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি।
আফরান নিশো
এইভাবে একে একে দেশের শীর্ষ তারকারাও মুখ খুলছেন, এই দমবন্ধ সময়ে। ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় সবচে বেশি বিচলিত হয়েছেন নাট্যাঙ্গনের মানুষ। ছোটপর্দার তারকা অভিনেতা আফরান নিশো তো একটি মর্ম বেদনাদায়ক কবিতাই লিখে ফেলেছেন। 'লাল সবুজের পতাকায় আজ কেন এত লাল'।
ন্যায়ের পক্ষে সুর মেলালেন দেশের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আফরান নিশো। বরং আরেক ধাপ এগিয়ে রইলেন, তার দীর্ঘ এক কবিতা রচনা করে। যে কবিতার মাধ্যমে এই তারকা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, 'লাল সবুজের পতাকায় আর তো লাল চাই না...'।
পাঠকের উদ্দেশ্যে ১৭ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফেসবুকে প্রকাশিত পুরো কবিতাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
আমার সোনার বাংলা/আমাদের প্রাণ.../লাল সবুজের পতাকা/সবুজের মাঝে লাল.../বাবা মুক্তিযোদ্ধা/চেতনা-/লড়বো যদি যাক প্রাণ.../লাল সবুজের পতাকা..../তাদেরই প্রতিদান/তাদের আত্মত্যাগের ঘ্রাণ...তবে আজ.../কেন এত... লাল???/সবুজে লাল খুঁজি...লালে নয় সবুজ/পতাকা হচ্ছে রক্তাক্ত.../পুরো জাতি কি আজ অবুঝ?/বলেন না?/মা বলেন...আর চাই না লাল.../ফিরিয়ে দাও.../আমার সবুজ।/লাল সবুজের পতাকায় আজ কেন এত লাল?/শান্তি চাই/হোক সংস্কার/অপমান চাই না/রক্তাক্ত রাজপথ চাই না/হোক সমাধান/লাল সবুজের পতাকায় আর তো লাল চাই না...'
এই কবিতাটির সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা লাল-সবুজ। ওই লাল কি এই সবুজ বাংলাদেশে চিরকালের জন্য বহমান থাকবে বলেই এই লাল-সবুজ প্রতীকের পতাকা? তাই কি অনবরত গুলি চলতে থাকবে এই বাংলাদেশে?
চমৎকার এই নিগূঢ় প্রতীকী পতাকা অবলম্বনে লেখা এই কবিতার লেখক ছোটপর্দার 'বস' নিশো সম্পর্কে বলা বলা দরকার, তিনি বড়পর্দারও বস। তার বড়পর্দায় প্রথমবারের মতো অভিষেক ঘটেছে রায়হান রাফীর 'সুড়ঙ্গ' সিনেমায়। টিভি নাটকের লম্বা ক্যারিয়ার ছাপিয়ে শুরুতেই ছক্কা হাঁকানোর মতো সিনেমা এটি। প্রথম ছবিতে সফলতার পর লম্বা সময় নিয়ে নতুন সিনেমার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন অভিনেতা। শোনা যাচ্ছে, তিনি রায়হান রাফীর 'অসিয়ত' নামের আরেকটি সিনেমায় যুক্ত হচ্ছেন। এখানেও নায়িকা হিসেবে পাচ্ছেন আবারও তমা মির্জাকে।
না বললেই নয়, নিশোর বাবা আবদুল হামিদ মিয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের সদস্য ও ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ফুসফুসে ক্যানসারজনিত রোগে ১ অক্টোবর ২০২০ সালে মৃতু্যবরণ করেন।
স্বস্তিকা মুখার্জী
কবীর সুমনের মতো কোটা ইসু্যতে মুখ খুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের আরেক তারকা অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জী। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক আবেগঘন পোস্টে নায়িকা লিখেছেন, প্রায় এক মাস হলো আমি নিজের দেশে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবরের চ্যানেলে তৃতীয় বিশ্বের কোনো খবরই তেমন একটা চলে না। আর আমি খুব একটা ফোনের পোকা নই, তাই এত খারাপ একটা খবর কানে আসতে দেরি হলো।
বাংলাদেশের স্মৃতি নিয়ে স্বস্তিকা লিখেন, এই তো কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ গেলাম, খুব ইচ্ছে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার। চারুকলা যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, জীবনের একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। প্রতিবার আসি, ব্যস্ততায় যাওয়া হয় না, মা'ও খুব যেতে চাইতেন বাংলাদেশ, নিয়ে যাওয়া হয়নি, কিন্তু আজ একটা ভিডিও দেখলাম, গুলির ধোঁয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আক্রান্ত। ছাত্র বয়স গেছে সেই কবে, তবে জাহাঙ্গীরনগর আর আমার যাদবপুর খুব কাছাকাছি। কাঠগোলাপের গাছগুলোও কেমন এক রকম। এক রকম আকাশের মেঘগুলোও। কেবল আজ ওখানে বারুদের গন্ধ।
'ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়/দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ/তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?/নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই/তোমার ছিন্ন শির, তিমির।'
এমন এক আপ্যায়নপ্রিয় জাতি দেখিনি, খাবারের নিমন্ত্রণ যেন শেষ হতেই চায় না, অমন সুন্দর করে সারা রাস্তা জুড়ে ভাষার আল্পনা আর কোথায় দেখব? নয়নজুড়ানো দেওয়াল লেখা? এ বোধহয় মুক্তিযুদ্ধের শপথ নেওয়া একটা জাতির পক্ষেই সম্ভব।
আজ অস্থির লাগছে। আমিও তো সন্তানের জননী। আশা করব, বাংলাদেশ শান্ত হবে। অনেকটা দূরে আছি, এই প্রার্থনাটুকুই করতে পারি। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো- সেই আমাদের আলো আলো হোক... ভালো হোক সবার।
পরীমনি
'নারীর প্রতি সহিংসতায় জবান বন্ধ থাকলে আপনি মুনাফিক।' কথাটি লিখেছেন পরিমনি। যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের একদফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় টোকাই-ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলকারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে তখন এ দৃশ্যটি চোখ এড়ায়নি মোটেও পরীমনির।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে এতদিন নীরব থাকলেও সরব হয়েছেন দেশের বিনোদনজগতের অনেক তারকা। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে কোটা সংস্কারের পক্ষে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন ঝাঁকে ঝাঁকে তারকা। নিন্দার ঝড় বইছে তাদের এই স্ট্যাটাসগুলোতে। সোমবার চিত্রনায়িকা পরীমনি আহত এক শিক্ষার্থীর ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, 'নারীর প্রতি সহিংসতায় আপনার জবান বন্ধ থাকলে আপনি মুনাফিক।'
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের পক্ষে দেওয়া পরীমনির ওই স্ট্যাটাসটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এমন স্ট্যাটাসের জন্য অনেকেই নায়িকার প্রশংসা করেছেন।
একজন লিখেছেন, 'যদি পোস্টটা মন থেকে দিয়ে থাকেন, এই ভালো কাজটার জন্য আপনার জন্যও অনেকের ভালো লাগা কাজ করবে'।
শেখ জাহিদুল নামে একজন লিখেছেন, 'আমি মৃতু্য পর্যন্ত যেই সংগঠনকে ঘৃণা করব, তার নাম ছাত্রলীগ'।
আরেকজন লিখেছেন, 'সত্যিকারের মানুষরাই নারীকে সম্মান করতে জানে'।
মেহের আফরোজ শাওন
চুপ থাকেননি মেহের আফরোজ শাওনও। যেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে উত্তাল সারাদেশ। রাজপথে নেমে এসেছেন সব শিক্ষার্থী। আন্দোলনের রেশ ধরে টোকাই-ছাত্রলীগের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে শিক্ষার্থীদের। আন্দোলনকারীদের ওপর টোকাই-ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় কি অভিনেত্রীরাও চুপ থাকতে পারেন? তারাও মুখ খুলেছেন। এবার অভিনেতা-অভিনেত্রী কেউ আর মুখ বন্ধ করে নেই। সবাই মুখ খুলছেন। নিন্দা জানাচ্ছেন সংঘর্ষ-পরম্পরায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়া ঘটনায় অভিনেত্রীরাও।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে যখন সারাদেশ উত্তাল, তখন তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এই শোবিজ অভিনেত্রীরাও। ছাত্রছাত্রীদের গায়ে হাত তোলায় প্রতিবাদে সরব হন তারাও।
বুধবার দুপুরে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিনেত্রী ও নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওন লেখেন, বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো এই নিরস্ত্র মানুষটাকে সরাসরি গুলি করা পুলিশ ভাই কি কাল রাতে ঘুমাতে পেরেছেন? উনার কি কোনো সন্তান আছে? সেই সন্তানের চোখের দিকে তাকাতে উনার কি একটুও লজ্জা লাগবে না! সেইসঙ্গে তিনি হ্যাশট্যাগ যোগ করে জানান, তিনি কোটা সংস্কারের পক্ষে।
কবীর সুমন
এদিকে কোটা আন্দোলন নিয়ে শুধু বাংলাদেশের তারকারাই বলছেন তা না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের খবর ছড়িয়েছেন দেশের বাইরেও। ভারতের চিত্র তারকারাও কথা বলতে শুরু করেছেন। কোটা আন্দোলন নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে এই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। কারণ তারাও দেখছেন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে সারাদেশে আন্দোলন করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। উত্তাল রাজপথ। আন্দোলনরতদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন চলচ্চিত্রশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও। এবার সেই ইসু্যতে একাত্মতা পোষণ করেছেন দেশের বাইরের তারকারাও। এরইমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিনোদন অঙ্গনের কয়েকজন তারকা এ নিয়ে কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, দুই বাংলার কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমনও। এ আন্দোলন নিয়ে তিনি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, আমি ভারতের নাগরিক। বাংলাদেশ আমাদের প্রতিবেশী। তার বিষয়-আশয়ে নাক গলানোর অধিকার আমার নেই। সেটা করতে চাইও না। তবু বাংলাদেশের অনেকের কাছ থেকে যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি তা ভুলে থাকতেও পারছি না। ভুলবই বা কেন। তিনি আরও লেখেন, ছবি দেখছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
একটু আগেই দেখলাম। মিছিল করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। নেপথ্যে শোনা যাচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের 'কারার ওই লৌহকপাট/ভেঙে ফেল্ কর রে লোপাট'- মনে হচ্ছে গানটি এডিট করে বসানো হয়েছে ভিডিওর সঙ্গে। ঠিক কাজই করা হয়েছে। কত সময়ে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমার গানের লাইন লিখে দিয়েছেন দেয়ালে। পশ্চিমবঙ্গে সে তুলনায় কিছুই দেখিনি। বলতে দ্বিধা নেই মনে মনে আমি বাংলাদেশেরও নাগরিক। কবীর সুমন লিখেছেন, আমার জীবনসায়াহ্ন কাটছে আমার মাতৃভাষায় খেয়াল রচনা করে, গেয়ে, শিখিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের সরকার আমার বাংলা খেয়ালকে স্বীকৃতি দিয়েছেন যদিও তাদের পেটোয়া এক শিল্পী বাংলা খেয়াল নিয়ে এবং সেই সঙ্গে আমায় বিদ্রম্নপ করেছেন এবং এই রাজ্যের সরকারঘনিষ্ঠ একটি পত্রিকা সেই বিদ্রম্নপ ও মগজহীন উদ্ভট বক্তব্য ঘটা করে ছাপিয়েছেন- আমার একটি ব্যঙ্গচিত্রসমেত। তিনি বলেন, আমার জীবনের সেরা কাজ এবং আমার জীবনসায়াহ্নের প্রধান কাজ বাংলা খেয়াল বাংলাদেশে চর্চা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের শিল্পী মরহুম আজাদ রহমান বেশ কিছু বাংলা খেয়াল রচনা করে গেছেন বিভিন্ন রাগে। বাংলা ভাষা আর বাংলা খেয়ালের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে আমি বাঁধা- ভালোবাসার বন্ধনে। গতবার ঢাকায় গানের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে যে সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি তা ভারতে পেয়েছি কবার? তার ভাষায়, এ হেন আমি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় চুপ করে বসে থাকতে পারি না। থেকেছি কয়েকদিন। আর পারছি না। কিন্তু অবস্থাটা যে ঠিক কী, কী কী কারণে যে এমন হলো এবং হচ্ছে, কারা যে এতে জড়িত তাও তো ঠিকমতো জানি না। তাও পঁচাত্তর উত্তীর্ণ এই বাংলাভাষী করজোড়ে সব পক্ষকে মিনতি করছি : অনুগ্রহ করে হিংসা হানাহানি বন্ধ করুন। ঢাকা সরকারকে অনুরোধ করছি : বাংলা ভাষার কসম শান্তি রক্ষার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। আপনাদের ছাত্রবাহিনী যেন হিংসার আশ্রয় না নেন। সবশেষে লিখেছেন, আর কী বলি। আমি তো সশরীরে যেতে পারছি না ঢাকায়। পারলে যেতাম। রাস্তায় বসে পড়ে সবাইকে শান্তিরক্ষার জন্য আহ্বান করতাম।