সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

সাত কারণে দেশে ফের বাড়ছে করোনার প্রকোপ

সাখাওয়াত হোসেন
  ১১ মার্চ ২০২১, ০০:০০
সাত কারণে দেশে ফের বাড়ছে করোনার প্রকোপ
করোনা সংক্রমণ রোধে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে মাস্কের ব্যবহার বাড়ছে -ফাইল ছবি

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ফের লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তা প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে ভিন্ন আশঙ্কা করছেন। তারা বলেন, গত কয়েকদিনে দেশে করোনায় শনাক্তের হার যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী তা কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক নয়। এটি সেকেন্ড ওয়েভের (দ্বিতীয় ঢেউ) আলামত হতে পারে, যা আগামী আরও তিন থেকে চার মাস দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, মৌসুমগত কারণে দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও তা এর একমাত্র কারণ নয় বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এর পেছনে আরও ছয়টি বড় কারণ রয়েছে। এর মধ্যে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এর প্রতি আস্থা সর্বস্তরের মানুষের করোনাভীতি পুরোপুরি কেটে যাওয়া এবং এর ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে 'থোরাই কেয়ার' মনোভাব সংক্রমণ বৃদ্ধিতে অন্যতম সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তির করোনার উপসর্গ প্রকাশ না পাওয়ার বিষয়টি করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশঙ্কাও করছেন তারা। আক্রান্ত করোনা রোগীর স্টেইন শনাক্তকরণে বিলম্ব ও টেস্টিং সংকটকে চতুর্থ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর বাইরে প্রবাস থেকে আগতদের নিয়ম অনুযায়ী কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা না করা, অতিরিক্ত লোক সমাগমের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ না থাকা এবং উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও করোনা টেস্ট না করিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানোর ঘটনার আধিক্য এ মহামারি নতুন করে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বস্তরের মানুষ এত বেশি আস্থাশীল হয়ে উঠেছে যে, দেশের যে স্বল্প সংখ্যক মানুষ নিয়মিত মাস্ক পরিধান করতেন-

তাদেরও একটি বড় অংশ সেখান থেকে সরে এসেছেন। আগে পথঘাটে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষের মুখে মাস্ক দেখা গেলেও এখন তা ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বিয়ে-সাদিসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান কিছুটা কম থাকলেও সম্প্রতি তাতে নতুন গতি পেয়েছে। এসব জনসমাগমে প্রায় সবাই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে খেয়ালখুশি মতো চলছে। গণপরিবহণে গাদাগাদি করে যাত্রীরা চলাচল করছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা মানুষের সিংহভাগই এখনো করোনা টিকা নেয়নি।

অন্যদিকে দেশে যে ৩৬ লাখ মানুষ এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছে, তাদের একটি বড় অংশ নিজেদের পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত ভাবতে শুরু করেছে। অথচ এদের শরীরে করোনাভাইরাস বাসা বাঁধলে তার উপসর্গ প্রকাশ না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাদের মাধ্যমে নিকটাত্মীয়-স্বজন বা সহকর্মীরা সহজেই আক্রান্ত হতে পারেন। অথচ এ ব্যাপারে দেশে সচেতনতা অনেক কম, যা সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন দেশে এসেছে কি না তা খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে বিলম্বের বিষয়টিও সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন দেশে প্রবেশ করেছে কি না সেটা পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডক্টর লেলিন চৌধুরী।

তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে ব্রিটেন বা ইউকে কিংবা সাউথ আফ্রিকা, ব্রাজিলের ভেরিয়েন্ট ঢুকে পড়েছে কি না; নাকি বাংলাদেশে নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট দেখা দিয়েছে- জিন সিকোয়েন্সিং করে সেটি দ্রম্নত নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এই মিউটেশনটির সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া মিউটেশনের চারিত্রিক কিছু মিল রয়েছে। এ নতুন ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসটি ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে পারে। রি-ইনফেকশন করতে পারে এবং মূল করোনাভাইরাসের বিপরীতে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি এই মিউট্যান্ট ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না। এ ধরনের মিউটেটেড ভাইরাসগুলো সাধারণত ভ্যাকসিনবিরোধী হয়ে থাকে। ভারতের সঙ্গে যেহেতু আমাদের আবহাওয়ার মিল রয়েছে এবং সে দেশের মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ যেহেতু আগের মতো অনেকটাই স্বাভাবিক, তাই সেখানকার মতো একই স্ট্রেইন দেশে প্রবেশ করেছে কি না এটি শঙ্কার বিষয়।

এদিকে দেশে গত কয়েক মাসে সংক্রমণের হার নিম্নমুখী হওয়ার পর নমুনা পরীক্ষায় ব্যাপক ঢিলেমি করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদ, আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে মানুষের মধ্যে নমুনা পরীক্ষার আগ্রহ অনেকাংশে কমে এসেছে। কারণ করোনা শনাক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সামাজিকভাবে কোনো সহায়তা পাচ্ছে না। এছাড়া বেশিরভাগ মানুষের কাজের নিশ্চয়তা নেই। দৈনিক মজুরিতে কাজ করা মানুষ নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হলে তাকে অর্থাভাবে পড়তে হবে। তাই উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরও অনেকে নমুনা পরীক্ষা করছেন না, যা নতুন করে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন তিনি।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, নমুনা পরীক্ষার জন্য বর্তমানে সরকার নির্ধারিত যে ফি রয়েছে, তা এখন উঠিয়ে দেওয়া উচিত। তার ধারণা, বিনা টাকায় নমুনা পরীক্ষার সুযোগ থাকলে এর গতি বৃদ্ধি পাবে, যা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।

দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারীরা বলেন, দেশের অফিস-আদালত ও শপিংমলসহ সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো অনেকটা বদ্ধ ধরনের। এসব জায়গায় বিপুল সংখ্যক মানুষ একই সময় জড়ো হচ্ছে। গত কয়েকদিনে গরমের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ মুখের মাস্ক খুলে রাখছে। অথচ এসব জায়গার বাতাস বের না হওয়ায় একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে অনেকে সংক্রমিত হচ্ছে। এছাড়া কোথাও কোথাও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও বৈদু্যতিক পাখা ব্যবহৃত হওয়ায় সেখানে একই বাতাস সঞ্চালিত হওয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে।

এদিকে বিদেশ থেকে আগতদের করোনাভাইরাস 'নেগেটিভ' সনদ না আনতে পারলে ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকার ব্যাপারে গত নভেম্বরে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করলেও পরে দ্রম্নত ধাপে সংক্রমণ কমতে থাকায় এতে ঢিলেমি ভাব দেখা দেয়। বিমানবন্দরে এ ব্যাপারে কিছুটা নিয়ম মেনে চলা হলেও স্থল ও সমুদ্র বন্দরে তা অনেকাংশেই মেনে চলা হচ্ছে না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই বেশ কয়েক মাস ধরে করোনার সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ফলে এ ব্যাপারে ঢিলেমি ভাব দেশের করোনার প্রকোপ বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে