শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

ভয়াল বন্যায় দুর্ভোগের কান্না

পানিবন্দিদের দুর্ভোগ চরমে দুর্গত এলাকায় খাদ্য সংকট দুই জেলায় ৩ লাশ উদ্ধার
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৯ জুন ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৯ জুন ২০২২, ০৯:১৭
ভয়াল বন্যায় দুর্ভোগের কান্না
ভয়াল বন্যায় দুর্ভোগের কান্না

হঠাৎ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ভারী বর্ষণ ও ভারতের কিছু অংশে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট ঢলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, নেত্রকোনা, গাইবান্ধাসহ কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা ভয়াল রূপ নিয়েছে। এই দুই জেলায় ২৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। দুর্গত এলাকার অনেকের কাছে এখনো ত্রাণসহায়তা না পৌঁছানোর অভিযোগ উঠেছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ বিদু্যৎহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে অতি প্রয়োজনীয় মোবাইল ফোনও বন্ধ হয়ে গেছে। বসতঘর তলিয়ে যাওয়ায় অনেকে ঘরবাড়ির ওপর আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে রান্নাবান্নার সুযোগও পাচ্ছেন না। নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে। দুর্গত অনেক এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষ-পশুতে একাকার হয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া জানান, আগামীকাল সোমবারের আগে সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আশা নেই। আর উত্তরাঞ্চলে আরও তিন থেকে চারদিন পানি বাড়তে থাকবে। তবে সেখানে পরিস্থিতি নাজুক হবে না। তিনি আরও বলেন, সোমবার থেকে পানি ভৈরব বাজার হয়ে নেমে যাবে। এতে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আর দেশের উত্তরাঞ্চলে আরও তিন থেকে চার দিন বন্যার পানি বাড়তে থাকবে। যমুনা অববাহিকায় পানি বাড়তে থাকবে। পরিস্থিতির খুব একটা অবনতি হবে না এ সময়। শনিবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সারাদেশেই আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হবে। কোথাও মাঝারি, কোথাও ভারী। আবার চার বিভাগে অতিভারী বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয়। এটি উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়ার সঙ্গে বিজলী চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে। আর সারারদশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা বলেন, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এদিকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সড়ক বাধা সৃষ্টি করলে তা কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম শনিবার বিকালে তার মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, সিলেটের অধিকাংশ রাস্তা তলিয়ে গেছে, রাস্তার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, কোথাও কোনো রাস্তার কারণে পানি অপসারণে বাধা পেলে সেই রাস্তা যেন কেটে ফেলা হয়। এর দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে দুর্গতদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে স্কুল-কলেজগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ স্বাক্ষরিত আদেশটি শনিবার সব আঞ্চলিক পরিচালক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্কুল-কলেজের প্রধানের কাছে পাঠানো হয়েছে। এদিকে দেশের দুই জেলায় বন্যার পানিতে নিখোঁজের পর ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় বন্যার পানিতে নিখোঁজ হওয়ার ১৫ ঘণ্টা পর কৃষক আশরাফ আলী (৬০) ও রাজমিস্ত্রি আবুল কালামের (৩৩) মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার সকাল ৭টায় আলাদা জায়গা থেকে ওই দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নেত্রকোনার দুর্গাপুরে নিখোঁজের ২২ ঘণ্টা পর শনিবার বেলা ২টায় চন্ডীগড় উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে থেকে মো. আক্কাস আলীর (২৭) লাশ উদ্ধার করেছে ডুবুরিদল। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের আঞ্চলিক অফিস, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর আমাদের সিলেট অফিস জানায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধারকাজে নৌবাহিনীর সদস্যরাও যুক্ত হচ্ছেন। তাদের সঙ্গে থাকছে বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার ও কোস্ট গার্ডের দুটি ক্রুজ। শনিবার সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান জানান, নৌ-বাহিনীর একটি দল জালালাবাদ ইউনিয়নে কাজ করছে এবং একটি দল কোম্পানীগঞ্জের দিকে রয়েছে। এর আগে শুক্রবার দুপর থেকে সিলেটে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তারা সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সিলেট সীমান্তবর্তী এলাকায় বন্যার পানিতে আটকেপড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) সদস্যরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সকাল ৬টায় সিলেটের প্রধান নদী সুরমার কানাইঘাট ও সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় অন্যান্য নদ-নদীর পানিও বাড়ছে। এদিকে বন্যার পানিতে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় এবার সিলেট রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম শনিবার দুপুরে বলেন, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশন আপাতত বন্ধ থাকবে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে এখন সরাসরি সিলেট স্টেশনে কোনো ট্রেন আসবে না। এর আগে সিলেটের কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পানি ঢুকে পড়ায় সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা বিদু্যৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শনিবার দুপুর সোয়া ১২টায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় বলে বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদের জানান। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের হিসাবে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৩৫ লাখের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মুজিবুর রহমান শনিবার বলেন, অনেক মানুষ পানিবন্দি, কিন্তু নৌকার অভাবে আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারছে না। বন্যায় অনাহারে থাকা লোকজন এখন কেবল প্রাণে বাঁচতে চান। কিন্তু একটি নৌকা মেলানো তাদের কাছে এখন সোনার হরিণ। এদিকে সিলেটে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। দুর্গত এলাকার অনেকের কাছে এখনো ত্রাণ সহায়তা না পৌঁছানোর অভিযোগ উঠেছে। নগরীর সাদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, 'এমন বন্যা আর কখনো দেখেনি। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে নগরীর অধিকাংশ এলাকা। বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। অনেক না খেয়ে দিন পার করছেন।' তালতলার এলাকার গৃহিণী সানজিদা ইসলাম জানান, 'সিলেটের অবস্থা ভয়াবহ। বিশুদ্ধ পানিসহ খাবারের সংকটে আছি। বাসার সব মালামাল পানিতে ডুবে আছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাটের ওপর বসে দিন কাটাচ্ছি।' নগরীর তেররতন এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবীর সুহিন বলেন, 'মানুষের কষ্টের এই সময়ে আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। জেনারেটরের সাহায্যে আমার বাসা থেকে খাবার পানি সরবরাহের পাশাপাশি শুকনা খাবারও বিতরণ করছি।' তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'বন্যার পানি বেড়ে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকায় সরকারি কোনো সহায়তা পৌঁছায়নি।' টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দিন দিন সিলেটের পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। অধিকাংশ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। অনেকে আশ্রয়ের খোঁজে এদিক-ওদিক ছুটছেন। গবাদিপশু ও ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে