রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটানোর পথ খুঁজছে আওয়ামী লীগ

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের ভেতরে নানা রকম গ্রম্নপিং বা কোন্দলের তৈরি হয়েছে। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন নেতার লোক হিসেবে দলের মধ্যেই নানা ভাগ তৈরি হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে এই বিরোধের বিষয়টি ভয়ংকরভাবে প্রকাশ পেয়েছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটানোর পথ খুঁজছে আওয়ামী লীগ

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে নৌকার প্রতিপক্ষ হিসেবে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী নামানোর কৌশল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য 'বুমেরাং' হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোটের লড়াই শেষ হলে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যকার বিভেদ দূর হয়ে যাবে দলের নীতি-নির্ধারকরা এমনটা আশা করলেও তা বরং আরও উসকে উঠেছে। নির্বাচনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সহযোগীদের মধ্যে ঘটছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা। এক পক্ষের বিরুদ্ধে অপর পক্ষের নেতিবাচক মন্তব্যে দলের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতি দ্রম্নত সামাল দিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পথ খুঁজছে। বিশেষ করে দলের হেভিওয়েট নেতারা যেভাবে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন এবং সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে বেফাঁস কথাবার্তা বলছেন- তা বন্ধ করার জন্য দ্রম্নত একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দলের নীতি-নির্ধারকদের আশঙ্কা, এ ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত দীর্ঘ স্থায়ী হলে স্থানীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন অপশক্তি এ সুযোগ কাজে লাগাবে। বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের রাজপথ উত্তপ্ত করে তুললে তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার সামর্থ্য হারাবে। আর এ পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানো আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের ভেতরে নানা রকম গ্রম্নপিং বা কোন্দলের তৈরি হয়েছে। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন নেতার লোক হিসেবে দলের মধ্যেই নানা ভাগ তৈরি হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে এই বিরোধের বিষয়টি ভয়ঙ্করভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতা তীব্র রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, স্থানীয় পর্যায়ের কোন্দল মেটানোর বিষয়টি দলীয় শীর্ষ নেতারা গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে। এ বিষয়ে বেশকিছু কৌশল নির্ধারণ করে তা থেকে চূড়ান্ত পথ খোঁজার কাজ চালানো হচ্ছে। এ পর্ব শেষ হলে তা বাস্তবায়নে জোর তৎপরতা চালাবে হাইকমান্ড।

তবে এ কৌশল কী হবে তা দলীয় নেতারা কেউ স্পষ্ট করেননি।

এদিকে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব সংঘাত মেটাতে হাইকমান্ডের কৌশলী পদক্ষেপে সহসাই সুফল মিলবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকেই এমনটা আশা করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে এর আগেও বেশ কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের বিশেষ টিম সারাদেশ ঘুরে নানা তৎপরতা চালিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ বিশেষ কিছু হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে তারা অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানোর কথা বললেও তলে তলে তা আরও জোরালো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলেন, দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়াটাই প্রমাণ করে যে এই কোন্দল আগে থেকেই ছিল, যা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও বেড়েছে। এটি সহজে মিলিয়ে যাবে না বলেই শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, বড় যেকোনো দলের জন্যই এরকম চ্যালেঞ্জ আছে, তবে ক্ষমতাসীন হওয়ায় আওয়ামী লীগের মধ্যে এ সংকট একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানো আওয়ামী লীগের জন্য সর্বোচ্চ মাত্রার একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হবে।

যদিও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিনের দাবি, পুরো বিষয়টিই নির্বাচন কেন্দ্রিক। শিগগিরই এর রেশ কেটে যাবে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দেবেন নেতাকর্মীরা তা মানবেন।

তবে এ প্রত্যাশা কতটা পূরণ হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন খোদ দলের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতাই। তাদের ভাষ্য, নানা কারণে দলীয় চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেছে। দলীয় পদ-পদবি হারানোর ভয়ে অনেকে প্রকাশ্যে হাইকমান্ডের নির্দেশনার বিরোধিতা করছেন না। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দল ঠিকই জিইয়ে রাখছেন। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দলের একপক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন।

তাদের এ বক্তব্য যে অমূলক নয়, তা নির্বাচনপরবর্তী মাঠপর্যায়ের চিত্র পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভোটের লড়াই শেষ হওয়ার পর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৬ জন খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধসহস্রাধিক। এর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে আহতের সংখ্যা অন্তত ৬০ জন। এছাড়া দুই শতাধিক ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে যেসব আসনে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নির্বাচনী বিরোধকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণসহ একটি প্রাইভেট কার ও তিনটি মোটর সাইকেলে আগুন দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়। সংঘর্ষে অন্তত সাতজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ জানায়, নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী ও পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়ার সমর্থকদের মধ্যে ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

এদিকে নির্বাচনোত্তর সংঘাত-সহিংসতার চেয়েও আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থীদের ভোটের গ্রহণযোগ্য নিয়ে তোলা বিভিন্ন প্রশ্ন এবং দলীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ দলকে বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। যা দলের হাইকমান্ডকে চরম দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। তাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত মেটানোর চেয়ে দলের হেভিওয়েট নেতাদের বেফাঁস বক্তব্যে লাগাম টানার বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগের লোকেরা যদি নিজেরা দোষ খুঁজতে থাকে, তাহলে তা বিরোধীদের আরও 'উৎফুলস্ন' করবে। তিনি এ ব্যাপারে জয়ী ও পরাজিত প্রার্থী সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।

তবে দলীয় হাইকমান্ডের এ ধরনের নির্দেশনা কতটা কাজে লাগবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, দলের হেভিওয়েট নেতারা এখনো যেভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে গিয়ে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তাতে দলের বড় ধরনের ইমেজ সংকটে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

উলেস্নখ্য, দেশের সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক শীর্ষ নেতা ও হেভিওয়েট প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়েও হেরেছেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। পরাজয়ের পর তাদের কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন ভোটের ফলাফল কারসাজির। নির্বাচনে অনিয়ম, কালো টাকা ও পেশিশক্তির কাছে হেরেছেন বলেও দাবি করেছেন অনেকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, এবার অনেকে হেরে গিয়ে যে ধরনের অভিযোগ করছেন, গত সংসদ নির্বাচনে তাদের অনেকেই একই কৌশল গ্রহণ করে ভোটে জিতেছিলেন।

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক জায়গায় কেন্দ্র থেকে কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ফলে যে প্রার্থীর পেশিশক্তি ও লোকবল বেশি ছিল, সেখানে তারা ইচ্ছেমতো নির্বাচনকে 'ম্যানুপুলেট' করেছে। ফলে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীদের অনেকেই হেরেছে। তারা এখন প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হচ্ছে।

মুন্সীগঞ্জে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের কাছে হেরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ও প্রভাবশালী নেতা মৃণাল কান্তি দাস অভিযোগ করেন, নির্বাচনের আগে থেকেই লাগাতার সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। জনগণ তাকে ভোট দিলেও ফলাফলে তা প্রতিফলিত হয়নি। তাই এই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন।

মানিকগঞ্জ-২ আসনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে সাবেক সাংসদ মমতাজ বেগম বলেন, তাকে সরানোর জন্য অনেক বড় ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে। ভোটের এই ফলকে তার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।

বরগুনা-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে পাঁচ বারের সংসদ সদস্য নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু অভিযোগ করেছেন, ভোটের ফলাফলে জালিয়াতি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ মাদারীপুর-৩ আসনে দলের সংরক্ষিত আসনের এমপি তাহমিনা বেগমের কাছে হেরে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, নির্বাচনে নৌকার ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে।

তাদের ছাড়াও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের এমন প্রায় ৩০ জনেরও বেশি এই নির্বাচনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরে কেন্দ্র দখল, ফলাফল জালিয়াতি, অস্তিত্বহীন ভোটারদের ভোট দেওয়া, কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের যেতে বাধা দেয়ার মতো অভিযোগ তুলেছেন।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একজন নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, এমনিতেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো প্রশ্ন তুলেছে। এরমধ্যে হেভিওয়েট নেতাদের এ ধরনের নেতিবাচক বক্তব্য বিষয়টিকে আরও ঘোলাটে করে তুলতে পারে। তাই দলীয় হাইকমান্ড এ ব্যাপারে সবাইকে কঠোরভাবে সতর্ক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্দেশনা না মানলে সংশ্লিষ্ট নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে