রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রাথমিকে পঞ্চাশের কম শিক্ষার্থী

৩শ' প্রতিষ্ঠান একীভূত হচ্ছে পাশের স্কুলে

প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা হবে না তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত চলতি বছর নিয়োগ হবে ১৪ হাজার শিক্ষক
যাযাদি রিপোর্ট
  ২২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

দেশের যেসব প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫০-এর কম এমন ৩০০টি স্কুলকে পাশের স্কুলের সঙ্গে একীভূত করা হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে এসব স্কুলের গত ১০ বছরের শিক্ষার্থীর ধারাবাহিকতা দেখা হবে। একত্রিত করার জন্য প্রস্তাবিত স্কুলের নাম, শিক্ষার্থী সংখ্যা, জমির পরিমাণ, যে স্কুলের সঙ্গে একত্রিত করা হবে তার নাম, বর্তমান বিদ্যালয় থেকে একত্রিত করার জন্য প্রস্তাবিত স্কুলের দূরত্ব ও প্রস্তাবিত স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা উলেস্নখের বিষয়গুলো আমলে নেওয়া হবে। তবে পার্বত্য অঞ্চলের স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে একীভূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।

অন্যদিকে, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রাথমিকে এখন থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িকের মতো কোনো পরীক্ষা হবে না। তবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন চলবে। এছাড়া চলতি বছরই প্রাথমিকে ১৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ। এ সময় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের

মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত উপস্থিত ছিলেন।

তিনি জানান, দেশের ৫৬ জেলায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৫০ জন শিক্ষার্থীও নেই এমন ৯৪৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব স্কুলের মধ্যে প্রায় ৩০০ স্কুলের গত ১০ বছরের শিক্ষার্থীর ধারাবাহিকতা যাচাইবাছাই করে দেখা গেছে যে, প্রতি বছর সেখানে ৫০-এর কম শিক্ষার্থী ছিল। এ রকম বেহাল স্কুলগুলোকে পাশের স্কুলের সঙ্গে একত্রিত বা একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বরিশাল শহরের একটি স্কুলের উদাহরণ দিয়ে সচিব বলেন, সেই স্কুলে গত দশ বছরে ৫-৭ জন শিক্ষার্থী ছিল। এসব স্কুল একীভূত করা হবে। অন্যদিকে, দেশের ৫০০-এর বেশি স্কুলে ১৫০০ বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। সেখানে ভর্তির জন্য আরও ৫০০-৭০০ শিক্ষার্থী অপেক্ষায় রয়েছে। এসব স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের অনেক স্কুল আছে যেখানে গড়ে ৩-৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যেটা যুগের পর যুগ এভাবে চলছে। এসব স্কুলের ক্ষেত্রে একীভূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।

চলবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সচিব ফরিদ আহাম্মদ জানান, 'নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এখন থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িকের মতো কোনো পরীক্ষা হবে না। তবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন চলবে।'

গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রথম বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম শুরু হয়। আর গত জানুয়ারি শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষে ওই তিন শ্রেণি ছাড়াও নতুন করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হয়েছে এই শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে (উচ্চ মাধ্যমিক) বাস্তবায়িত হবে নতুন শিক্ষাক্রম।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বছরে তিনটি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হতো।

যেহেতু এ বছর প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে তাই সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা ছিল তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আগের মতো প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক বা বার্ষিক পরীক্ষা হবে কি না। জবাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, মূল কথা হলো তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক- এটি আর থাকবে না। মূল্যায়নের পদ্ধতি ভিন্ন হবে, যেহেতু ধারাবাহিক মূল্যায়ন। মূল্যায়ন হবে কিন্তু আগের মতো গতানুগতিক না। ধারাবাহিক মূল্যায়ন থাকবে।

নিজেদের উদ্যোগেই ছাপানো হবে পাঠ্যবই

সচিব ফরিদ আহাম্মদ জানান, জাতীয় কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাথমিকের বই ছাপিয়ে আসলেও সেই কাজ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে করতে চায় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সম্মতি মিলেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।

তিনি বলেন, এনসিটিবির কাজ কারিকুলাম তৈরি ও পর্যালোচনা করা। বই ছাপানোর কাজটি প্রশাসনিক। অন্যদিকে এনসিটিবি প্রাথমিকের বই ছাপাতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ খরচ, সময় ও জটিলতা তৈরি হচ্ছে। প্রাথমিকের বই ছাপানোর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সেই অর্থে এনসিটিবি বই ছাপায়।

তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক প্রতিটি বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবিকে দুই টাকা ৬০ পয়সা করে সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। সে হিসেবে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বই ছাপালে এই টাকাটা সরকারের সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে বইয়ের মান খারাপ হলে কখনও প্রাথমিক অধিদপ্তর, এনসিটিবি একে অন্যকে দোষারোপ করে। যেহেতু এনসিটিবি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো তদারকি ও খবরদারি করতে পারে না। প্রাথমিক অধিদপ্তর বই ছাপার কাজটি করলে তদারকি ও মান রক্ষা করতে সহজ হবে।

ফরিদ আহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। তাদের জন্য প্রতি বছর ১০ কোটির বেশি বই ছাপানো হয়ে থাকে। ১৩ বছর ধরে ৯৮ লটে ৩০-৩২টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব বই মুদ্রণ করা হচ্ছে। এই বই নিয়ে ৮-৯ বছর ধরে নানান সিন্ডিকেট কাজ করছে। এ জন্য বইয়ের মুদ্রণ ও কাগজের মান নিয়েও প্রতি বছর প্রশ্ন উঠছে। এসব বিতর্ক এড়াতেই প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই নিজেরাই ছাপানোর উদ্যোগ নেয়।

১৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ চলতি বছরে

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০২৩ সালে প্রাথমিকে ৩৭ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৩ হাজার ৭৮১ জন শিক্ষক নিয়োগ হবে। এই নিয়োগ কার্যক্রম শেষ হলে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে ১:৩০ অর্থাৎ প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক। যা এসডিজি অর্জনের পথে অনেক ধাপে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা।

সচিব জানান, স্বাধীনতা পর একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৫১ হাজার ৩৫৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। শিক্ষক নিয়োগের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ করার এসডিজির যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার আগেই আমরা পূরণ করতে পারব।

নকল ধরবে 'সুরক্ষা' ডিভাইস

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদের নিয়োগ পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইসের জালিয়াতি সংখ্যা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরীক্ষক দিয়ে সেই জালিয়াতি বন্ধ করতে পারছে না অধিদপ্তর। এবার ডিজিটাল ডিভাইস জালিয়াতি ধরতে অভিনব এক মেশিন বানিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় 'সুরক্ষা' নামে এ যন্ত্রটি পরীক্ষায় জালিয়াতির ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারীকে চিহ্নিত করবে। পরীক্ষার হলে কোনো পরীক্ষার্থীর কানে বা অন্যকোনো অঙ্গে কোনো ডিজিটাল ডিভাইস ঢোকানো থাকলে হলে অথবা কোনো পরীক্ষার্থী ওই ধরনের ডিভাইস কানে রেখে থাকলে বুয়েট উদ্ভাবিত যন্ত্রে একটি লাইট জ্বলে উঠবে এবং শব্দ সংকেত বেজে উঠবে।

আগামী ২০ মার্চ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের ৫টি জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এই ডিভাইস প্রতিরোধ যন্ত্র ব্যবহার করা হবে বলে জানান সচিব ফরিদ আহাম্মদ।

তিনি জানান, 'কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় জালিয়াতির উদ্দেশ্যে কানের ভেতরে ডিজিটাল ডিভাইস রাখলে এই যন্ত্র তার সন্ধান দেবে। যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে 'সুরক্ষা'। আগামী ২৯ মার্চ তৃতীয় ধাপে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের যে পরীক্ষা হবে, ওই পরীক্ষা থেকেই নকল ধরতে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হবে। বাংলাদেশে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো এই যন্ত্রটি ব্যবহার শুরু করতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ সফলতা পেয়েছি। সেজন্য আগামী ২৯ মার্চ পরীক্ষামূলকভাবে যন্ত্রটির ব্যবহার শুরু হবে। খুব শিগগিরই এর শতভাগ ব্যবহার শুরু হবে।' সফল হলে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর ডিজিটাল জালিয়াতির রোধে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করবেন বলে আশা করেন তিনি।

সচিব বলেন, জালিয়াতির ডিভাইস কোনো পরীক্ষার্থীর কানে ঢোকানো হলে অথবা কোনো পরীক্ষার্থী ওই ধরনের ডিভাইস কানে রেখে থাকলে বুয়েট উদ্ভাবিত যন্ত্রে একটি লাইট জ্বলে উঠবে এবং শব্দ সংকেত বেজে উঠবে।

সচিব জানান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার প্রতিরোধে যন্ত্র উদ্ভাবনের জন্য বুয়েটের আইআইটিসি-কে ইনোভেশন ফান্ডের আওতায় ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ যন্ত্র তৈরিতে প্রাথমিকভাবে ৮ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হবে। পরে বেশি উৎপাদন করা হলে দাম পড়বে ৫ হাজার ৫০০ টাকা।

ফরিদ আহাম্মদ বলেন, 'আগামী ২৯ মার্চ তৃতীয় ধাপের নিয়োগ পরীক্ষা থেকেই এই যন্ত্র ব্যবহার করা হবে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় ২৫টি যন্ত্র দিয়ে ৫টি টিম করে পরীক্ষা কেন্দ্রে এই যন্ত্রের পাইলটিং করা হবে। পরীক্ষার্থী বেশি এমন ৫টি জেলা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিলস্না, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ এই জেলাগুলোতে আমরা পাইলটিং করবো।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে