বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
তেলের ট্যাংকারে আগুন

হরিষে বিষাদ

অগ্নিদগ্ধ হেলালের স্ত্রী সোনিয়ার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর সংসারে সুখের নতুন বার্তা নিয়ে এসেছিল
যাযাদি ডেস্ক
  ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ট্রাকচালক হেলাল হাওলাদারের স্ত্রী সোনিয়া আক্তারের আহাজারি -সংগৃহীত

ট্রাকচালক হেলাল হাওলাদারের সঙ্গে কৈশোরেই বিয়ে হয় সোনিয়া আক্তারের। তরুণ চালক হেলাল যখন ট্রাক নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যেতেন, কিছুক্ষণ পরপরই স্ত্রী ফোন করে খোঁজ নিতেন। সোনিয়ার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর সম্প্র্রতি তাদের সংসারে সুখের নতুন বার্তা নিয়ে এসেছিল।

সোমবার বরগুনা থেকে ট্রাকে তরমুজ বোঝাই করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন হেলাল। মঙ্গলবার ভোরে পরিবার খবর পায়, আগুনে পুড়ে হেলাল ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি। সেই খবরে বরগুনা থেকে সোনিয়াসহ স্বজনেরা ছুটে এসেছেন ঢাকায়। চিকিৎসকরা বলছেন, হেলালের শরীরের শতভাগ পুড়েছে, পুড়ে গেছে শ্বাসনালিও। তার অবস্থা সংকটাপন্ন।

হাসপাতালে পৌঁছে হেলালকে একবার দেখে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী সোনিয়া। একটাই কথা তার, তাদের সন্তান যেন বাবার মুখটা দেখতে পায়।

শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের ষষ্ঠতলায় হাই ডিপেন্ডেন্সি (এইচডিইউ) ইউনিটের সামনে কথা হয় সোনিয়া এবং তার স্বজনদের সঙ্গে। তারা কাঁদছিলেন, প্রার্থনা করছিলেন, যেন হেলাল সুস্থ হয়ে ওঠেন।

একই ঘটনায় দগ্ধ আরও সাতজন ভর্তি আছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে, তাদের পরিবারের সদস্যরাও ষষ্ঠতলায় জড়ো হয়েছিলেন একই প্রার্থনা নিয়ে।

পুলিশ বলছে, তেলবাহী একটি ট্যাংকার গাবতলী থেকে সাভারে যাওয়ার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোড়পুল এলাকার কাছে ইউ টার্ন নিতে গিয়ে উল্টে যায়। তাতে ট্যাংকারের তেল ছড়িয়ে আগুন ধরে যায়।

সেই আগুনে পুড়ে যায় আরও দুটি ট্রাক ও একটি সেডান। আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃতু্য হয়। নজরুল ইসলাম নামে এক তরমুজ বেপারী মারা যান হাসপাতালে নেওয়ার পথে।

ওই আগুনে দগ্ধ হয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন বরিশালের বাকেরগঞ্জের মিলন (২২), বরগুনার আল আমিন (৩৫), মিম (১০), নিরঞ্জন (৪৫), ট্রাকচালক হেলাল (২১), হেলপার সাকিব (১৬) ও রাজশাহীর আবদুস সালাম (৩৫) ও আরেক ট্রাকের চালক মো. আল আমিন (২২)।

ওই তরমুজের ট্রাকে ছিলেন চালক হেলাল, হেলপার সাকিব, তরমুজের বেপারি নজরুল ইসলাম, নিরঞ্জন, আল আমিন এবং তার ১০ বছরের মেয়ে মিম।

দগ্ধদের মধ্যে হেলাল, সাকিব ও নজরুল ইসলামকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন আলী হাসান নামে এক পোশাক কর্মী। দুপুরেও বার্ন ইনস্টিটিউটে পোড়া রোগীদের স্বজনদের সঙ্গে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় তাকে।

আলী হাসান বলছেন, চন্দ্রায় কারখানায় যাওয়ার জন্য ভোর ৬টায় জোরপুল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তিনি দেখেন গাড়িতে আগুন লেগেছে। তিনজন লোক রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কাতরাচ্ছেন।

তখন তিনি ৯৯৯ এ ফোন করে একটি অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চলে এলে তিনি তিনজনকে নিয়ে প্রথমে সাভার স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে যান। সেখানে ভর্তি না নিলে তাদের নিয়ে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের দিকে রওনা হন।

তরমুজ ব্যবসায়ী আল আমিন ঢাকা যাচ্ছেন শুনে তার সঙ্গী হয়েছিল তার ১০ বছরের মেয়ে মিম। বাবা-মেয়ে দুজনেই পুড়েছেন। মোবাইলে মিমের এই ছবি দেখিয়ে কাঁদছিলেন তার দাদা।

দগ্ধদের মধ্যে তরমুজের বেপারী নজরুল কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন। স্ত্রীর নম্বর দিয়ে ফোনও করতে বলেন।

আলী হাসান বলেন, 'আমি নজরুলের স্ত্রীকে ফোন করে ঘটনা জানানোর কিছুক্ষণ পর গাড়ি যখন কল্যাণপুরে, তখন ছটফট করতে করতে নজরুল মারা গেলেন।'

বাকি দু'জন ট্রাকচালক হেলাল ও হেলপার সাকিবও তাদের পরিবারকে জানাতে বলে, ফোন নম্বর দেয়। তাদেরও দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে দেন আলী হাসান।

হেলপার সাকিবের বড় ভাই নাঈম এসেছেন হাসপাতালে। তিনি বলছেন, অভাবের কারণে তাদের দুই ভাইয়ের কারও পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি। তিনি ভবন নির্মাণের জন্য পাইলিং শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

তাদের বাবা খাগড়াছড়িতে অটোরিকশা চালান। আর ছোট ভাই সাকিব স্কুল ছেড়ে কয়েকমাস হয় ট্রাকে উঠেছে হেলপার হিসেবে। তাদের মা বরগুনাতেই থাকেন। সাকিব ডিউটি না থাকলে মায়ের সঙ্গেই থাকতেন

নাঈম পাইলিংয়ের কাজ করছিলেন বাগেরহাটের মোংলায়। ভোরবেলায় সাকিবের দগ্ধ হওয়ার খবর শুনে ছুটে এসেছেন ঢাকায়।

চিকিৎসকরা বলছেন, সাকিবের শরীর শতভাগ পুড়ে গেছে। এই খবর জানার পর থেকে নাঈম কেঁদেই চলেছেন।

বার্ন ইনিস্টিউটের সহকারী পরিচালক হোসাইন ইমাম বলছেন, চালক হেলালের মতো হেলপার সাকিবের জীবনও সংকটাপন্ন।

তেলবাহী এই ট্যাংকার গাবতলী থেকে সাভারে যাওয়ার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোড়পুল এলাকার কাছে ইউ টার্ন নিতে গিয়ে উল্টে যায়। তাতে ট্যাংকারের তেল ছড়িয়ে আগুন ধরে যায়।

ওই ট্রাকেই ছিলেন তরমুজ ব্যবসায়ী আল আমিন ও তার ১০ বছরের মেয়ে মিম। বাবা-মেয়ে দু'জনেই পুড়েছেন। মিমের শ্বাসনালিও পুড়েছে।

খবর শুনে হাসপাতালে এসেছেন আল আমিনের বাবা শহীদ তালুকদার। তিনি বলেন, বরগুনা থেকে আল আমিন তরমুজ নিয়ে ঢাকায় যাবে শুনেই মিম জেদ করতে থাকে বাবার সঙ্গে আসার জন্য। মেয়ের জেদে পরাস্ত হয়ে বাবা তাকে ট্রাকে তুলে নেন। ইচ্ছা ছিল সাভারে মামাবাড়িতে নামিয়ে দেবেন মিমকে। কিন্তু তার আগেই ট্রাকে আগুন লেগে যায়।

শহীদ তালুকদার বলেন, এই মৌসুমে তরমুজ চাষ ও তরমুজ কিনতে ঋণ করে টাকা লগ্নি করেছিলেন আল আমিন।

ওই ঘটনায় পুড়ে গেছে প্রিমিয়ার সিমেন্টবাহী একটি ট্রাক। ট্রাকের চালক দগ্ধ আল আমিন (২২) জানান, তারা মুন্সীগঞ্জ থেকে সাভারে যাচ্ছিলেন। আগুন দেখে তিনি লাফিয়ে বের হয়েছেন। কিন্তু তার হেলপার ইকবাল সেখানেই পুড়ে মারা গেছে।

দগ্ধ হয়েছেন শ্রমিক মিলন মোলস্নাও। তার ভাষ্য, ঘটনাস্থলে 'অজ্ঞাত পরিচয়' হিসেবে যে লাশটি রয়েছে সেটি হেলপার ইকবালের। ট্রাক শ্রমিক মিলন মোলস্নার পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করছেন উদ্বেগ নিয়ে।

একই আগুনে পুড়েছেন এ কে এইচ গ্রম্নপের গাড়িচালক আব্দুস সালাম। তিনি জানান, গাড়িতে তেল নিয়ে বের হতেই তিনি আগুনের কবলে পড়েন। তার শরীরের ৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুরে দগ্ধ এসব রোগী দেখে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, 'দগ্ধদের কেউ শঙ্কামুক্ত নয়। আর এসব ক্ষেত্রে আমরা একটা কথা সবসময় বলি, বাড়ি ফেরা না পর্যন্ত এসব রোগীকে শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না।' সূত্র: বিডিনিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে