সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ধানের বাম্পার ফলনেও কৃষকের মুখে হাসি নেই

আলতাব হোসেন
  ১০ মে ২০২৪, ০০:০০
ধানের বাম্পার ফলনেও কৃষকের মুখে হাসি নেই

এবার সারাদেশে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। মাঠে-ঘাটে-উঠানে সোনা রঙা ধান হাসছে। তবে শ্রমে-ঘামে ফলানো ধান নিয়ে বাজারে গিয়ে কৃষকের হাসি মলিন হচ্ছে। ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কৃষকের জীবনে অতিপরিচিত ঘটনা। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। মৌসুমের দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়তি দামের তেতো অভিজ্ঞতায় কৃষক। লোকসানের গঁ্যারাকলে পড়েছেন প্রায় দেড় কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক।

সূর্য ওঠার আগেই কাস্তে হাতে মাঠে ছুটছেন কৃষক। সারা দেশে চলছে ধান কাটার উৎসব। ধান মাড়াই, বাছাই আর বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত কৃষক-কৃষানি। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া, বরেন্দ্র অঞ্চল, মাগুড়া, দিনাজপুর ও নওগাঁ এলাকায় আগাম জাতের ধান কাটা হয়ে গেছে। বরেন্দ্র অঞ্চল ও ময়মনসিংহের পাহাড়ি এলাকায় ধান কাটা ও মাড়ানোর মিছিলে যোগ দিয়েছেন নারী কৃষি শ্রমিকরাও। একদিকে ধানকাটা হচ্ছে, অপরদিকে সেই ধান মাড়াই করা হচ্ছে। রাস্তায় ধান মাড়াই ও শুকানো হচ্ছে।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানভেদে কোথাও ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা মণে ধান বিক্রি হচ্ছে। অনেক এলাকায় উৎপাদন খরচই ওঠছে না কৃষকের। আবার কোথাও কোথাও উৎপাদন খরচ উঠলেও কৃষকের শ্রম আর ঘামের কোনো মূল্য থাকছে না। এ দিকে নতুন বোরো ধান কম দামে বিক্রি হচ্ছে। সেই চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে।

দেশের রংপুর, মাগুড়া, ময়মনসিংহ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, জামালপুর, গাজীপুর, দিনাজপুর, নওগাঁ, মেহেরপুর, জয়পুরহাট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও হবিগঞ্জ এলাকার কৃষকরা জানান, চলতি বোরো মৌসুমে ধানের দাম না পাওয়ায় হতাশ তারা। ময়মনসিংহের কাশিগঞ্জ বাজারে ধান বিক্রি করতে এসেছেন হাসিম মিয়া। তিনি বলেন, ১৫ দিন আগে আমার ধানকাটা শেষ হয়। তখন এই হাটে ৬৮০ টাকা মণে ধান কিক্রি করেছি। সরকার সঠিক সময়ে ধানের দাম নির্ধারণ না করায় কৃষকরা লোকসানে ধান বিক্রি করেছেন। অথচ বুধবার সেই ধান ৮৫০ টাকা মণে বিক্রি হয়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'এখন দাম বাড়লে আমাদের কৃষকদের কোনো লাভ নেই। এখন বাজার ফড়িয়া ও চালকল মালিকদের হাতে, তারা লাভবান হবেন। কৃষকরা বলছেন, এর মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে এসেছে ঝড় ও শীলাবৃষ্টি। এতে ধানের ক্ষতি হচ্ছে। বাধ্য হয়েই কৃষকরা লোকসানে ধান বিক্রি করছেন।

বোরো ধানের দরপতন ঠেকাতে বুধবার থেকে ১২৮০ টাকা মণে ধান কিনছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে ধানের দাম। তবে টোকেন বাণিজ্যর কারণে এখনো প্রকৃত কৃষকরা সরকারি গুদামে দাম বিক্রি করতে পারেননি। অনেকে নেতা ধরেও ধান বিক্রি করতে পারছেন না। সরকারি ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা কৃষক সেজে ধান বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।

সাধারণ কৃষক চেয়ারম্যান, মেম্বার ও নেতা ধরেও স্স্নিপ বা টোকেন পাচ্ছেন না। টোকেন ছাড়া খাদ্য কর্মকর্তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে কৃষকের ধান নিচ্ছেন না। আর যাদের কাছে টোকেন বা স্স্নিপ আছে তারা ধান দিতে পারছেন। ময়মনসিংহের ফুলপুরের কাশিগঞ্জ এলাকার কৃষক আকবর আলী বলেন, 'ধান কাটার পর বাজারে ধান নিয়ে গেলে ৬৮০ টাকা মণ দাম বলে ফড়িয়ারা। ১২শ' ৮০ টাকা না হোক এক হাজার টাকা মণে ধান বিক্রির জন্য নেতাদের পিছু দৌড়াচ্ছি। আমি টোকেন পাইনি। অথচ আমার চাচাতো ভাই ছমির টাকা দিয়ে টোকেন কিনছে।'

বোরো ধান উৎপাদনে কেমন খরচ হয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরের বারমারি গ্রামের ফজলু আমিন জানান, 'এক বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য পাঁচ কেজি ধানের বীজ প্রয়োজন হয়। হীরা বীজ ধানে খরচ হয় ১৮০০ টাকা, ৬০ কেজি ইউরিয়া সারে ব্যয় হয় ১৮০০ টাকা, টিএসপি সারে খরচ হয় ২৫০০ টাকা, সেচ খরচ হয় ৮ হাজার টাকা, চাষাবাদ বাবদ খরচ হয় ৫ হাজার টাকা। ধান রোপণে খরচ হয় ৫ হাজার টাকা, কীটনাশক বাবদ খরচ হয় ৪ হাজার টাকা, আগাছা পরিষ্কার বাবদ খরচ ৪ হাজার ৫০০শ' টাকা, ধানকাটা বাবদ খরচ হয় ১০ হাজার ৪০০ টাকা আর ধান মাড়াই খরচ হয় ৩ হাজার টাকা, ধানঝাড়া বা পরিষ্কার বাবদ মজুরি খরচ ২ হাজার টাকা। ধান বিক্রি করার জন্য বাজারে নিতে ট্রলি ভাড়া ৩ হাজার টাকা। সারা দেশে বোরো উৎপাদনে কৃষকদের খরচ প্রায় একই রকম।'

হিসাব কষে দেখা যায়, এক বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদে কৃষকের খরচ হয় ৫১ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি ধান উৎপাদন হয় ৮৪ মণ। বর্তমান বাজার দর ৭০০ টাকা মণে ধান বিক্রি করলে কৃষক পাচ্ছেন ৫৮ হাজার ৮০০ টাকা। উৎপাদন ব্যয় ৫১ হাজার বাদ দিলে কৃষকের লাভ থাকে ৭ হাজার ৮০০ টাকা। আর ৬৫০ টাকা ধরে ধান বিক্রি করলে কৃষকর কোন লাভ থাকে না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর মাগুড়া, যশোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা ঋণ পরিশোধ ও দৈনন্দিন খরচের মেটাতে মৌসুমের শুরুতেই বাজারে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা মণে ধান বিক্রি করছেন। ডিজেল, সার, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ বাড়ায় এবার তাদের মুনাফা হয়নি। দিনাজপুরের হিলিতে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচও উঠছে না, দাবি কৃষকদের। তারা বলেন, বিঘাপ্রতি ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা মালিককে দিলাম, পানি ৬ হাজার টাকা, চাষ- রোপণ-কর্তনের খরচ যেয়ে আমাদের আয় আসছে না।

জয়পুরহাটের কালাইয়ের কৃষক তারা মিয়া বলেন, এবার চিকন ধান এক বিঘাতে ৩০ থেকে ৩২ মণ হয়েছে। এখন বর্তমান বাজারে ৭০০ টাকা মণ। বোরো এক বিঘা জমিতে বর্গা নিয়ে আবাদ করে খরচ প্রায় ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এতে বিঘাপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। নিজের পরিশ্রম ও মজুরি ছাড়াই এই লোকসান হচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে ধান কাটতে শ্রমিক সংকটে পড়েন গাজীপুরের কৃষকরা। দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। শ্রীপুর উপজেলার কর্ণপুর গ্রামের কৃষক সালাম বলেন, পাকিতে ১৪ মণ ধান পেয়েছি। বর্গা করায় জমির মালিককে অর্ধেক দিতে হয়েছে। কামলাদের দিনপ্রতি ১ হাজার টাকা বা বিঘাপ্রতি ৭ হাজার টাকা খরচের পর নিজের কিছুই থাকে না।

বাগেরহাটে ধান কাটা শ্রমিক সংকট ও শ্রমিকের মজুরি নিয়ে বিপাকে পড়েন কৃষকরা। শ্রমিক সংকটের মধ্যে এক হাজার টাকা শ্রমিকদের দিতে হয়। ৭০০ টাকা মণে ধান বিক্রি করে মজুরি দিতে গেলে তিন বেলার খাবারসহ প্রায় দুই মণ ধান বিক্রি করতে হয় প্রতিদিন একজন শ্রমিকের জন্য। মজুরির পাশাপাশি দিতে হচ্ছে তিন বেলার খাবার। বাজারে ধানের মূল্য না থাকায় কৃষক উৎপাদন খরচই উঠাতে পারছেন না। ধানের দাম না থাকায় চরম হতাশায় পড়েছেন তারা। হাওড় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে নতুন মোটা ধান সর্বোচ্চ ৭৫০, চিকন ধান সর্বোচ্চ ৭৮০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে কৃষকের লোকসান গুনতে হয়। এতে কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। কৃষকরা জানান, প্রতি মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৯০০ টাকা। বর্তমান বাজারদরে উৎপাদন খরচ উঠছে না তাদের। এনজিও'র সুদ ও মহাজনের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন। এ নিয়ে অনেক কৃষক দুশ্চিন্তায় আছেন।

বোরো ধান হলো হাওড় এলাকার কৃষকদের প্রধান ও একমাত্র অর্থকরী ফসল। বছরের একটি মাত্র ফসল ধান খোরাকির জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করে সারা বছর চলতে হয় তাদের। হাওড়ে বোরো ধানই হলো হাজারো কৃষকের জীবন-মরণ। এবার আগাম বন্যার আশঙ্কায় কাঁচা ধান কেটে কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। তারপর আঘাত করেছে শিলাবৃষ্টি। এ বিষয়ে লেঙ্গড়ার কৃষক আলসম বলেন, আমাদের গ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর যতটুকু রক্ষা করতে পেরেছেন, তার দামে ক্ষুব্ধ স্থানীয় কৃষকরা। টাঙ্গাইলের রূয়াপুরের কৃষক আব্দুল কাদির বলেন, এবার বৃষ্টি হয়নি, এতে ধানে চিটা হয়েছে। তারপর ধান পাকা অবস্থায় শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়। এরপর বাজারে ৭০০ টাকা মণে ধান বিক্রি করছি। তিনি হিসাব কষে বলেন, এবার লোকসান হয়েছে। সেচের পানির জন্য পাম্প মালিককে বেশি টাকা দিতে হয়েছে। ছাড়াও ধান কাটতে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিতে হয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে লোকসানের পালস্না ভারি হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওড়ের বাজার কলমাকান্দা বাজারে নতুন ধান নিয়ে আসেন কৃষক ও পাইকাররা। ট্রলারযোগে ও নৌকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ধান আমদানি হচ্ছে। বাজারের প্রায় শতাধিক আড়তে এসব ধান বিক্রি হচ্ছে। ধান নিয়ে এসেছেন লেঙ্গড়া গ্রামের সুনীল হাজং। তিনি মোবাইলে বলেন, প্রতিমণ ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে গড়ে ৯০০ শ' টাকা। অথচ বাজারে ভেজা ধান বিক্রি হয় ৭২০ টাকা আর শুকনা বিক্রি হচ্ছে ৮৭০ টাকায়। ধান বিক্রি করতে আসা কৃষক সুরুজ আলী বলেন, ধান লাগানো থেকে শুরু করে সেচ-সার-কীটনাশক ও ধান কাটা ও পরিবহণ খরচ বিঘাতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এবার ধান উৎপাদন হয়েছে ৪০ মণ। প্রতি মণ ৭০০ টাকায় বিক্রি হিসেবে বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় দুই হাজার টাকা। এ অঞ্চলের কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ধান রোপণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে