এবার বর্ষায় অনেক সড়ক-মহাসড়ক অক্ষত থাকা না থাকা নিয়ে রীতিমতো শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রচন্ড তাপদাহে বিটুমিন গলে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই কয়েক দিনের বৃষ্টিতে অনেক সড়ক-মহাসড়কে সৃষ্টি হয়েছে ছোট বড় নানা খানাখন্দের। এতে বর্ষায় সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে পারে বলে। এ পরিস্থিতিতে ঝুঁকি কমাতে বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিটের সড়ক-মহাসড়ক তৈরির তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্য, এ ব্যাপারে সরকারের উচিত এখনই সম্মিলিতভাবে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যথায় রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদি বড় ধরনের আর্থিক লোকসান গুনতে হবে। দেশের উন্নয়ন স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে হলে এবং সড়ক-সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে অবশ্যই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় যেভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, অদূর ভবিষ্যতে দেশকে এর হাড়ে হাড়ে মাশুল দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, একটি বিটুমিনের রাস্তা তৈরি করতে যদি ১ কোটি টাকা খরচ হয়, সেই একই রাস্তা কংক্রিট দিয়ে তৈরি করতে খরচ পড়বে মাত্র ১০ লাখ টাকা বেশি। অর্থাৎ ১০ শতাংশ বেশি খরচ হবে। বিটুমিনের রাস্তা প্রতি বছর মেরামত করতে হবে। আর কংক্রিটের রাস্তা প্রতি বছর মেরামত করার কোনো প্রয়োজনই পড়বে না। একটি কংক্রিটের রাস্তা নূ্যনতম ২০ বছর অনায়াসে টিকে থাকবে। যদি বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। একটি বিটুমিনের সড়ক প্রতি বছর মেরামত করতে হয়।
এতে করে ৫০ বছরে সড়কটির সংস্কারে যে অর্থ পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ওই সড়কের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কংক্রিটের মহাসড়ক তৈরি করা সম্ভব। এতে করে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় কম হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগের অধ্যাপক ও এক্সিডেন্টাল রিচার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারের উচিত দীর্ঘমেয়াদি সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করা। এজন্য প্রথমত প্রয়োজন সরকারের মানসিকতার পরিবর্তন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা।
তিনি আরও বলেন, অদূরে ভবিষ্যতে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। আগামী ১০০ বছর পর কি হবে তা আমরা বলতে পারছি না। তবে ধারণা করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যাবে। এ বছর যে তাপমাত্রা ছিল আগামী বছর তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। এজন্য সেই অনুযায়ী সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করতে হবে।
ড. হাদিউজ্জামান বলেন, দেশেই বর্তমানে উন্নত মানের সিমেন্ট ও রড তৈরি হচ্ছে। দেশে পাথরও পাওয়া যায়। সেই সিমেন্ট, পাথর, রড, বালু দিয়েই দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা আন্তর্জাতিকমানে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করতে সক্ষম। এতে করে নানা দিক থেকে দেশ লাভবান হবে। নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোতে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। বিদেশ থেকে বিটুমিন কিনতে হবে না। কারণ দেশে ব্যবহৃত বিটুমিনের ৮৫ শতাংশই আমদানি করা হয়। অধিকাংশ বিটুমিন আমদানি করতে হচ্ছে ইরাক ও পাকিস্তান থেকে। দেশে ডলারের দাম বাড়ায় এসব বিটুমিন আমদানিতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কংক্রিটের সড়ক-মহাসড়কে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে যানবাহন চলাচল করলেও কোনো সমস্যা হবে না। অথচ বিটুমিনের সড়ক-মহাসড়কে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজন নিয়ে যানবাহন চলাচল করতে হয়। তবে যেসব রাস্তায় বিটুমিন আছে সেখানে প্রচলিত বিটুমিনের পরিবর্তে পলিমার মডিফাইড বিটুমিন (পিএমবি) ব্যবহার করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে রংপুর মহাসড়ক কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। মহাসড়কটিতে কোনো ধরনের জয়েন্ট বা সংযোগ বা ভাগ ভাগ করা হচ্ছে না। কারণ ভাগ করলে বা জয়েন্ট দিলে সেই জয়েন্টে অদূর ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেই চিন্তা করেই একেবারে পুরোপুরি জয়েন্ট লেস বা জোড়াহীন মহাসড়ক তৈরি করা হচ্ছে। এসব সড়ক-মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কোনো প্রয়োজনীয়তা পড়বে না। কংক্রিটের সড়ক এমনিতেই অনেক তাপ সহ্য করতে পারে। ৫৫ থেকে ৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপ অনায়াসে শোষণ করতে পারে। কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। তবে মহাসড়কের ভেতরে ব্যবহৃত হিট আয়রণ বার বা তাপ নিয়ন্ত্রিত রড (টেম্পারাচার স্কেল) ব্যবহার করা হলে কংক্রিটের মহাসড়ক ৮৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা শোষণ বা সহ্য করতে পারবে। এতে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। এমনকি মহাসড়ক ফেঁটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। দেশের উন্নয়ন স্থায়ী করতে সড়ক-মহাসড়ক কংক্রিট দিয়ে তৈরির কোনো বিকল্প নেই। যদি সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে স্বাভাবিক কারণেই ঠিকাদারদের মন খারাপ হবে। কারণ বছর বছর আর সড়ক-মহাসড়ক মেরামত বা সংস্কার করার প্রয়োজন হবে না। এতে হয়তো সংশ্লিষ্ট অনেকেই অখুশি হবেন। তবে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সরকারকে একটা না একটা সময় কংক্রিটের সড়ক তৈরিতে যেতে হবে। অন্যথায় রাষ্ট্রকে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, কংক্রিটের সড়ক-মহাসড়ক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। খুশির খবর হচ্ছে কংক্রিট দিয়ে তৈরি হচ্ছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। সরকারের পক্ষ থেকে নূ্যনতম ছয় বছরের মধ্যে সড়কের কোনো ক্ষতি হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এজন্য ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তার কাছ থেকে কংক্রিটের মহাসড়ক তৈরির প্রয়োজনীয় নকশাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে জেনে নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিটুমিন বাদ দিয়ে সড়ক-মহাসড়ক কংক্রিট দিয়ে তৈরি করলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। কারণ বিটুমিন কালো। কালো রং আলো বা তাপকে শোষণ করে। যে কারণে রাতে রাস্তায় চলা যানবাহনের আলো তুলনামূলক কম দেখায়। কংক্রিটের সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির আলো আরও উজ্জ্বল দেখাবে। এছাড়া কংক্রিটের সড়ক থেকে তাপ বের হয়ে মানুষের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে না। কিন্তু বিটুমিনের রাস্তা থেকে যখন তাপ বের হয়, তখন পুরো গাড়ি বা যানবাহন পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। এতে করে যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রম্নটি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং মাঝে মধ্যেই ত্রম্নটি দেখাও দেয়। প্রতিটি টোল পস্নাজা তৈরি করা হয়েছে কংক্রিট দিয়ে। দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রাখতেই তা করা হয়েছে। তাহলে কেন রাস্তা কংক্রিটের করা হচ্ছে না। তার অর্থ একেবারেই পরিষ্কার। সংশ্লিষ্ট এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি আছেন, যারা আসলে চান না দেশে কংক্রিটের রাস্তা তৈরি হোক। কারণ এতে বছর বছর সংস্কার করার প্রয়োজন হবে না। পকেটে বছরে বছরে কাড়ি কাড়ি কাঁচা টাকাও আসবে না।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে ২২ হাজার ৪৪৬ কিলোমিটার সড়ক আছে। যার মধ্যে ৩ হাজার ৯৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক। ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক। বাকি ১৩ হাজার ৫৫৮ কিলোমিটার জেলা সড়ক।
ড. হাদিউজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, গত কয়েক দশকের মধ্যে এবার দেশে সবোর্চ্চ তাপমাত্রা ছিল। অতিরিক্ত তাপের কারণে বিটুমিন গলে দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক উঁচুনিচু হয়ে গেছে। নিম্নমানের বিটুমিন ও পরিমাণ অনুযায়ী ব্যবহার না করায় সড়ক-মহাসড়কে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে কোথাও কোথাও বিটুমিন শক্ত হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও থেকে বিটুমিন পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে। কারণ বিটুমিনের মূল শত্রম্ন হচ্ছে পানি। যেখানে পানি পড়বে, সেখানে কোনোভাবেই নিম্নমানের বিটুমিন থাকবে না। আসন্ন বর্ষায় সড়ক-মহাসড়কের অবস্থায় আশঙ্কাজনক হারে খানাখন্দের সৃষ্টি হতে পারে। যদি আগে আগে এর মেরামত করা না হয়, তাহলে ভোগান্তির সীমা থাকবে না। তার সঙ্গে বাড়তি যন্ত্রণা হিসাবে যোগ হবে সড়ক দুর্ঘটনা। স্বাভাবিক কারণেই দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়বে।