শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

পরিবারের কাছে ফিরলেন আবদুলস্নাহর নাবিকরা

যাযাদি ডেস্ক
  ১৫ মে ২০২৪, ০০:০০
পরিবারের কাছে ফিরলেন আবদুলস্নাহর নাবিকরা

সোমালি জলদসু্যদের হাত থেকে মুক্ত এমভি আবদুলস্নাহর নাবিকরা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছেন, যাদের জন্য দুই মাস ধরে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কেটেছে স্বজনদের।

মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি-১) জেটিতে ভিড়ে নাবিকদের বহনকারী জাহাজটি।

এরআগে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় কুতুবদিয়ায় নোঙর করে এমভি আবদুলস্নাহ। সেখান থেকে লাইটার জাহাজ জাহান মনি-৩ নাবিকদের নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।

তাদের জন্য আগে থেকেই জেটিতে অপেক্ষায় ছিলেন কারো মা, ভাই-বোন, কারো স্ত্রী-সন্তান। কেউ কেউ সঙ্গে এনেছেন জাতীয় পতাকা। তাই নেড়ে তারা

নাবিকদের স্বাগত জানান।

জাহান মনি-৩ জেটির কাছাকাছি আসার পর ২৩ নাবিক ডেক থেকে হাত নেড়ে অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের সাড়া দেন।

নাবিকদের স্বাগত জানাতে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটিতে উপস্থিত আছেন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম সোহায়েল। নাবিকদরা জেটিতে নামার পরই তাদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়।

সাধারণত নাবিকরা ছয় মাস বা আরও বেশি সময়ের জন্য জাহাজে করে দেশ ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যান। জাহাজ ভিড়ে বিশ্বের নানা বন্দরে। তাই দীর্ঘ সময় প্রিয়জনদের অনুপস্থিতিতে খানিকটা অভ্যস্ত থাকেন নাবিকদের স্বজনরা।

কিন্তু এবারের ফেরা অন্য রকম। দুই মাস আগে ভারত মহাসাগরের সোমালিয়া উপকূলে সশস্ত্র সোমালি জলদসু্যদের কবলে পড়ে আবদুলস্নাহ; নাবিকরা হন জিম্মি। পরিবারের সদস্যদের ফোন করে তারা জানান, মুক্তিপণ না দিলে তাদের একে একে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

সেই ১২ মার্চ থেকেই পরিবারের সদস্যদের ফিরে পেতে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর অনিশ্চিত অপেক্ষার শুরু।

এরপর সমুদ্র পথের নিরাপত্তায় থাকা আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো এমভি আবদুলস্নাহকে অনুসরণ করে, অভিযান চালিয়ে জাহাজ মুক্ত করার আগ্রহ দেখায়। স্থলভাগ থেকে সোমালি পুলিশের জলদসু্যদের ঘিরে ফেলার খবর আসে। জিম্মি জাহাজে পানি ও খাবার ফুরিয়ে আসার খবর উদ্বেগ বাড়ায়। একের পর এক ঘটনায় নাবিকদের পরিবারে বাড়তে থাকে দুশ্চিন্তা।

জিম্মি হওয়ার এক মাস পর যখন মুক্তি পান নাবিকরা, তখন সেই উদ্বেগের অনেকটা লাঘব হয়। কিন্তু স্বজনদের কাছে পাওয়ার অপেক্ষার শেষ হয়নি তখন। মঙ্গলবার বিকালে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের জেটিতে সেই অপেক্ষার অবসান হলো।

গত ১২ মার্চ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে সোমালিয়া উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে জলদসু্যদের কবলে পড়ে এমভি আবদুলস্নাহ। অস্ত্রের মুখে জাহাজ ও ২৩ নাবিককে জিম্মি করে দসু্যরা।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ৩৩ দিন পার করার পর গত ১৩ এপ্রিল রাত ৩টার দিকে জলদসু্যরা জাহাজ ছেড়ে চলে যায়। এরপর দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় জাহাজটি।

এমভি আবদুলস্নাহ শুরুতে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল-হামরিয়া বন্দরে। সেখানে জাহাজে থাকা কয়লা খালাস করা হয়। এরপর ওই বন্দরেই পণ্য লোডের পর মিনা সাকার বন্দরে যায় আবদুলস্নাহ। সেখান থেকে আরব আমিরাতের ফুজাইরা বন্দরে থেমেছিল জ্বালানি নিতে। এরপর দুবাই থেকে ৩০ এপ্রিল রওনা হয় চট্টগ্রামের উদ্দেশে। বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে জাহাজ প্রবেশের খবর আসে বৃহস্পতিবার।

জিম্মি দশার দুই মাস পর দেশে ফিরে এমভি আবদুলস্নাহ এখন কুতুবদিয়া চ্যানেলে নোঙর করা আছে। সোমবার রাতেই সেখানে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস শুরু হয়েছে। জাহাজে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন পাথর আছে। দুইদিন পণ্য খালাসের পর আবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে আসার কথা রয়েছে। সেখানে বাকি পণ্য খালাস করা হবে।

রাজুর অপেক্ষার প্রহর গুনছেন মা

নোয়াখালী থেকে আবু নাছের মঞ্জু জানান, জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজের এবি (অ্যাবল সি ম্যান) মোহাম্মদ আনারুল হক রাজুর (২৯) মা দৌলত আরা বেগম ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করে তার জন্য বাড়িতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।

মঙ্গলবার বিকালে দৌলত আরা বেগম নিজেই বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'বাপজানের সঙ্গে দেখা হবে এতে আমরা সবাই আনন্দিত। আমি গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ, খাইসসারা (সিমের বীচি) ও ডাল রান্না করেছি। রাতে পোলাও রান্না করব। ছেলে আমার বুকে আসবে এটাই আমাদের আনন্দ।'

মোহাম্মদ আনারুল হক রাজু নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের আজিজুল হক মাস্টার ও দৌলত আরা বেগমের ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাজু তৃতীয় এখনো বিয়ে করেননি।

স্থানীয় বামনী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পাস করার পর বামনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন রাজু। এরপর চট্টগ্রামের ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট (এনএমআই) থেকে সিডিসি কোর্স সম্পন্ন করেন।

জিম্মিদশা থেকে মুক্তির এক মাস পর স্বজনদের কাছে ফিরেছেন এমভি আবদুলস্নাহর ২৩ নাবিক। জলদসু্যদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া এ ২৩ নাবিককে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে এসে পৌঁছেছে এমভি জাহান মনি-৩। বিকাল ৪টার দিকে জাহাজটি জেটিতে পৌঁছায়। এক মাস আগে সোমালিয়ার জলদসু্যদের কাছ থেকে (জিম্মিদশা) মুক্ত হওয়া এমভি আবদুলস্নাহ বাংলাদেশের কুতুবদিয়ায় নোঙ্গর করে সোমবার সন্ধ্যায়। কিন্তু দেশে ফিরলেও স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাদের আরও একদিন অপেক্ষা করতে হয়।

রাজুর বাবা আজিজুল হক মাস্টার বলেন, 'রাজু বাড়িতে এসে ঈদ করার কথা ছিল। এবার ঈদের সময় আমরা ঈদ করতে পারিনি? আজ আমাদের ঈদ। নামাজ পড়ে মহান আলস্নাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। ছেলেকে ছাড়া আমরা খুবই কষ্টে দিন অতিবাহিত করেছি। ছেলে নতুন পাকা ঘর করছে। এবার বাড়িতে আসলে ছেলেকে বিয়ে করাব। আলস্নাহ যেন আমার ছেলেকে সহিসালামতে বাড়িতে আনে।'

রাজুর বড় ভাই জিয়াউল হক রনি বলেন, 'আব্বা আম্মার বয়স হয়েছে। আমাদের বাড়ি থেকে কেউ চট্টগ্রাম যায়নি। চট্টগ্রামে থাকা আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা দেখা করতে গেছে। আমার ভাই আসবে বাড়িতে এটাই আমাদের আনন্দ।'

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী বলেন, 'রাজুর পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। রাজুর ঘরে আনন্দ বইছে। ভালো রান্না-বান্না হচ্ছে। অতীতের ন্যায় সবসময় যে কোনো প্রয়োজনে রাজুর পরিবারের পাশে উপজেলা প্রশাসন ছিল, আছে এবং থাকবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে