শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

এমপি আনার হত্যা :গ্রেপ্তার কসাইয়ের লোমহর্ষক বর্ণনা

বাংলাদেশে গ্রেপ্তার তিনজন ৮ দিনের রিমান্ডে ভারতে গ্রেপ্তার জিহাদ ১২ দিনের রিমান্ডে
গাফফার খান চৌধুরী
  ২৫ মে ২০২৪, ০০:০০
আনার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আমানুলস্নাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী ওরফে সাজি ও সিলিস্তা রহমানকে শুক্রবার ঢাকা সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। আদালত ৩ জনের ৮ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন -ফোকাস বাংলা

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পর তার শরীর থেকে হাড়-মাংস ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে ঝোপ-ঝাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। শিয়াল কুকুর বা বন্যপ্রাণী যাতে সেই মাংস দ্রম্নত খেয়ে ফেলে, এ জন্য মাংস সুস্বাদু করতে তাতে মশলা মেশানো হয়। শিয়াল কুকুরের পেটে মাংস হজম হয়ে গেলে, তা কোনোভাবেই শনাক্ত করা সম্ভব হবে না, এমন ধারণা থেকেই লাশ গুম করতে খুনিরা এমন অভিনব কৌশল নেয় খুনিরা।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, আনার হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার দায়ে বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের গোপালনগরের বনগাঁও অঞ্চল থেকে জিহাদ হাওলাদার (২৪) নামে এক কসাইকে গ্রেপ্তার করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দারা। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে আনার হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন জিহাদ।

জিহাদের বরাত দিয়ে সূত্রটি জানিয়েছে, চারজন মিলে প্রথমে আনারকে শ্বাসরোধে খুন করে। এরপর পুরো শরীর কেটে আলাদা আলাদা টুকরো করা হয়। তারপর সেইসব টুকরো থেকে হাড় ও মাংস পুরোপুরি আলাদা করা হয়। পরে সেসব মাংস ও হাড়ের ছোট ছোট টুকরো পলিথিনে ভরে তা সু্যটকেসে ভরে বাইরে নেয়া হয়। সেসব মাংস ও হাড়ের টুকরো ফেলে দেয়া হয় বিভিন্ন জায়গায়।

সূত্রটি বলছে, বৃহস্পতিবার রাতে জিহাদকে নিয়ে যাওয়া হয় ভাঙড়ের একটি জায়গায়। সেখানকার বাগজোলা খালে ডুবুরিরা অভিযান চালায়। তবে শুক্রবার পর্যন্ত সেই খাল ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালায় সিআইডি। তবে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত আনারের কোন দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি।

একজন ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ঢাকার ডিবি ও পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি পুলিশের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্স হয়। দুই দেশের তদন্তকারী সংস্থা দুইটির মধ্যে আনার হত্যাকান্ডের তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথাবার্তাও হয়েছে।

দায়িত্বশীল একজন ঊর্র্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া আনার হত্যা মামলার তিন আসামিকে আট দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকার ডিবি পুলিশ। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গে ১২ দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কসাই জিহাদকে।

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য মোতাবেক, আনারকে হত্যার পর তার শরীর কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর সেসব টুকরো থেকে চামড়া আলাদা করে ফেলা হয়। তারপর হাড় ও মাংস আলাদা করা হয়। মাংস ছোট ছোট টুকরো করা হয়। একইভাবে হাড়গুলোও ছোট ছোট টুকরো করা হয়। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাংস সুস্বাদু করতে তাতে মেশানো হয় মশলা। মশলাযুক্ত মাংসগুলোর ছোট ছোট পলিথিনে ভরা হয়।

মাংসের টুকরোগুলো কলকাতার যে ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয় তার সামনের রাস্তার খানিটা দূরে একটি পাবলিক টয়োলেটের পাশের ঝোপ-ঝাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। যাতে করে শিয়াল কুকুরে মাংসগুলো দ্রম্নত খেয়ে ফেলে। এ জন্যই মাংসে সুস্বাদু মশলা মেশানো হয়েছিল। খুনিদের ধারণা, মাংস শিয়াল কুকুরের পেটে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তা হজম হয়ে যাবে। আর কোনো শিয়াল বা কুকুর সেই মাংস খেয়েছে তা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। আর একবার মাংস হজম হয়ে গেলে সেই শিয়াল বা কুকুরকে ফরেনসিক বা ডিএনএ পরীক্ষা করেও আনারের লাশ শনাক্ত হওয়ার কোনো সম্ভবনা থাকবে না।

এমন অভিনব কৌশলে খোদ দুই দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও হতবাক। ইতোপূর্বে এমন অভিনব কৌশলে লাশ গুম করার ঘটনা কোন দেশে ঘটেছে কিনা তা জানা যায়নি। তবে ঘটনাটি নজিরবিহীন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ জানান, ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় দুই দেশই সম্মিলিতভাবে ঘটনাটির তদন্ত করছে। সার্বক্ষণিক পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। হত্যার পর আনারের লাশ টুকরো টুকরো করে গুমের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেয়া হয় বলে গ্রেপ্তাররা জানিয়েছে।

দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল রোববার আনার হত্যার বিষয়ে তদন্ত করতে ভারতে যাচ্ছে ডিবির একটি চৌকস দল। সেখানে বাংলাদেশে রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে জিহাদের দেয়া তথ্য মিলিয়ে দেখাসহ আনার হত্যাকান্ডের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার দুপুরে জিহাদকে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করে দেশটির সিআইডি পুলিশ। পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়, অভিযুক্ত জিহাদ বাংলাদেশি এবং একজন 'দক্ষ কসাই'। অবৈধভাবে মুম্বাইয়ে বাস করছিলেন তিনি। তার পিতার নাম জয়নাল হাওলাদার। তিনি খুলনার দিঘলীয়ার বাসিন্দা। দুই মাস আগে তাকে কলকাতায় নিয়ে আসেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের নির্দেশে জিহাদ ছাড়াও আর তিনজন মিলে এমপি আনারকে হত্যা করে। এরপর লাশ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেয়।

আবেদনে আরও বলা হয়, মরদেহের অংশ উদ্ধার করা অথবা দেহাংশ সরাতে ব্যবহৃত পস্নাস্টিক বা ট্রলি কোথায়, তা জানার জন্য জিহাদের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) বিচারক শুভঙ্কর বিশ্বাস শুনানি শেষে জিহাদকে ১২ দিনের রিমান্ডে পাঠান।

এর আগে জিহাদকে আনার হত্যাকান্ডের ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়। জিহাদের বিরুদ্ধে আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ, অপরাধমূলক নরহত্যা, তথ্য লোপাট অর্থাৎ অস্ত্র ও মরদেহ পরিকল্পনা মোতাবেক সরিয়ে ফেলার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এদিকে শুক্রবার এমপি আনার হত্যা মামলায় বাংলাদেশে গ্রেপ্তার তিন আসামি তানভীর, শিমুল ভূঁইয়া ও একমাত্র নারী আসামি সিলাস্তি রহমানকে আট দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালত। শুক্রবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের হাজির করা হয়। এ সময় মামলার সুষ্ঠু-তদন্তের জন্য আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন ডিবি পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফজুর রহমান। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত ২৩ মে তাদের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় ডিবি পুলিশ।

প্রসঙ্গত চলতি বছরের ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মন্ডলপাড়া লেনে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। পরদিন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বেরিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। পাঁচ দিন পর গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনারের নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তারপরেও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তিন বারের আওয়ামী লীগের এমপি আনারের। গত ২২ মে কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের বি ইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনারের খুন হয়েছেন বলে তথ্য মিলে। ঘরের ভেতরে রক্ত পাওয়া যায়। তবে ঘরে কোন লাশ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় গত ২২ মে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।

জানা গেছে, আনারের দেহাংশ ট্রলিতে ভরে ক্যাবে করে সরিয়ে নেওয়া হয়। সেই ক্যাব জব্দ হয়েছে। একই সঙ্গে যে ট্র্যাক্সি হত্যাকান্ডে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেটিও জব্দ হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে