রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২
টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড যাচাই-বাছাই শুরু

অনিশ্চয়তায় ৪৩ লাখ মানুষের ভাগ্য!

সাখাওয়াত হোসেন
  ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অনিশ্চয়তায় ৪৩ লাখ মানুষের ভাগ্য!

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ফ্যামিলি কার্ড এক পরিবারে একটি দেওয়ার কথা থাকলেও অনেকেরই রয়েছে একাধিক। এমনকি বিপুলসংখ্যক সচ্ছল পরিবারকেও এ কার্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ যাদের এ কার্ড পাওয়ার কথা তাদের অনেকেই তা পাননি। এ ছাড়া ছবি পরিবর্তন করে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের কার্ড অন্যদের দিয়ে দেওয়া এবং ঘুষ না দেওয়ার কারণে কার্ড পাওয়া থেকে বঞ্চিত করার ঘটনাও ঘটেছে বিস্তর।

এ নিয়ে শুরু থেকে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও বিগত সরকারের আমলে তা কেউ কানে তোলেনি। তবে সম্প্রতি হাতে লেখা এসব ফ্যামিলি কার্ড যাচাই-বাছাই করে স্মার্ট কার্ড তৈরির কাজে হাত দিয়েছে সরকার। আর এর পরপরই ফাঁস হতে শুরু করে নানা অনিয়মের তথ্য। বেরিয়ে আসে, একই পরিবার শহর-গ্রাম কিংবা ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে একাধিক ফ্যামিল কার্ড নিয়েছেন- তাদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এ পর্যায়ে ৪৩ লাখ ফ্যামিলি কার্ড স্থগিত করে তা যাচাই-বাছাই শুরু করা হয়েছে। যদিও এ অনিয়মের বাইরেও তথ্যগত ভুল-ভ্রান্তি ও অস্পষ্টতার কারণে বেশকিছু কার্ড যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায় ঢুকেছে।

এ প্রসঙ্গে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, এক কোটি পরিবার কার্ডের মধ্যে ৫৭ লাখ কার্ডকে স্মার্ট কার্ডে রূপান্তর করা হয়েছে। বাকি ৪৩ লাখ কার্ড স্মার্ট কার্ডে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। এখন তথ্য হালনাগাদ ও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এর মধ্যে যদি কোনো কার্ডে অনিয়ম ধরা পড়ে তাহলে, সেই কার্ড বাতিল করা হবে। তবে এখন এক কোটি কার্ডধারী সবাইকে পণ্য দেওয়া হচ্ছে।

হুমায়ুন কবির জানান, টিসিবির

ফ্যামিলি কার্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনিয়মের খবর আসছে। এক ব্যক্তি একাধিক জায়গায় এই কার্ড দিয়ে পণ্য নিচ্ছেন, এই হচ্ছে মূল অভিযোগ। পরিবার কার্ডের এসব সমস্যা দূর করার জন্য স্মার্ট কার্ড তৈরি করা হচ্ছে, যেন এক পরিবারে এক ব্যক্তির বেশি কেউ কার্ড না পান।

তার দাবি, কার্ডগুলোকে স্মার্টকার্ডে রূপান্তরে তথ্য হালনাগাদ করার জন্য টিসিবির পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনকে চারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কার্ডধারীদের তথ্য পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জনসহ (যদি প্রয়োজন হয়) হালনাগাদ বিভিন্ন তথ্য দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনে সাম্প্রতিক রদবদলের কারণে টিসিবির হাতে এসব তথ্য এখনো আসেনি। সেজন্য বাকি ৪৩ লাখ কার্ড স্মার্ট কার্ডে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে সময় লাগছে। এখন পুরনো কার্ডেই পরিবারগুলোর কাছে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার পরপরই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এ কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে।

টিআইবির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'কার্ড না পাওয়ার উলেস্নখযোগ্য কারণ হচ্ছে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি বা তথ্য প্রচারে ঘাটতি ছিল। এ ছাড়া তালিকা থেকে বাদ পড়ার অন্য কারণ হিসেবে কারও সুপারিশ বা তদবির জোগাড় করতে না পারা, রাজনৈতিক বিবেচনায় সচ্ছল ব্যক্তিদের তালিকাভুক্তকরণ, একই পরিবারে একাধিক কার্ড প্রদান, ছবি পরিবর্তন করে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের কার্ড অন্যদের দিয়ে দেওয়া, ঘুষ না দেওয়া কারণে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে বলে উলেস্নখ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার তালিকায় গ্রাম পুলিশ, আনসার সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, ল্যাব টেকনিশিয়ান, চিকিৎসক, পলস্নী চিকিৎসক, সাংবাদিক ইত্যাদি ধরনের সচ্ছল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার জন্য নির্ধারিত পণ্য ডিলার পর্যায়ে অন্যত্র বিক্রির প্রমাণ পায় টিআইবি। যদিও এর দায় তখন নিতে চাননি সংশ্লিষ্ট ডিলার ও কাউন্সিলররা।

গবেষণায় টিআইবির সার্বিক পর্যবেক্ষণ, 'গবেষণা প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো ফ্যামিলি কার্ড প্রাপ্তি এবং সাশ্রয়ীমূল্যে পণ্য ক্রয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ফ্যামিলি কার্ড কর্মসূচি জনস্বার্থে গৃহীত সরকারের একটি কর্মসূচি; সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সক্ষমতা যাচাইপূর্বক যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি না নিয়েই দ্রম্নত এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বিভিন্ন পর্যায়ে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হয়েছে। উপকারভোগীর তালিকাভুক্তি ও পণ্য ক্রয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে একদিকে প্রকৃত উপকারভোগীদের একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ ফ্যামিলি কার্ড তালিকা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে, অন্যদিকে উপকারভোগীদের চাহিদা, পণ্য ক্রয়ের সামর্থ্য এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রবেশগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনা না করায় দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এই ইতিবাচক উদ্যোগের সুফল যথাযথভাবে পৌঁছাচ্ছে না, যা এই কর্মসূচির উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করেছে। তথ্য প্রকাশ ও প্রচারে ঘাটতি থাকার কারণে লক্ষিত উপকারভোগীদের উলেস্নখযোগ্য অংশ এই কার্যক্রমের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং একই সঙ্গে দুর্নীতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া ফ্যামিলি কার্ড কর্মসূচিতে কার্যকর অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা না থাকায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ফ্যামিলি কার্ড নিয়ে শুরু থেকেই যেসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বিগত সময়ের ওইসব অনিয়ম শিগগিরই দূর করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী সরকার।

এদিকে টিসিবির ট্রাকের পণ্য অনেক মানুষ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কিনতে পারছেন না বলে সংবাদমাধ্যমে যে অভিযোগ উঠেছে এ প্রসঙ্গে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, নির্দিষ্টসংখ্যক পরিবারের জন্য বরাদ্দ থাকে। প্রতিটি স্থানে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য বরাদ্দ থাকে। পরিবেশকদের বলা হয়েছে, ৩৫০টি টোকেন দেওয়ার জন্য। এর বেশি দেওয়া সম্ভব নয়। যারা টোকেন পাবেন না, তাদের সেদিনের জন্য চলে যেতে হবে। ফলে ৩৫০ জনের বেশি মানুষ থাকলে বাকিদের পরের দিন আসতে বলা হয়।

তিনি আরও জানান, পবিত্র রমজান মাসে ফ্যামিলি কার্ডধারীদের দুই কেজি মসুর ডাল, দুই লিটার ভোজ্যতেল, এক কেজি চিনি ও এক কেজি ছোলা দেওয়া হবে। এ ছাড়া মহানগর এলাকায় এক কেজি খেজুর দেওয়া হবে। রোজার সময় পণ্য ট্রাকে বিক্রি হবে কি না, তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, যেসব পরিবেশকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠবে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না, নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে